নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার »
মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান সংঘাতের বাহানায় কৌশলে রোহিঙ্গাদের রাখাইন থেকে বিতাড়িত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে মিয়ানমার। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রামের রোহিঙ্গাদের এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। এতে করে আবারও বাংলাদেশে রোহিঙ্গা ঢলের আশঙ্কা করা হচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির সংঘাতের বিষয়ে নজর রাখা বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থা ও সীমান্তে বসবাসরত বাসিন্দাদের ভাষ্যমতে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিষয়ে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না গেলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে নতুন করে অন্তত দুই লাখ রোহিঙ্গা বিতাড়িত হবে। আর এসব রোহিঙ্গার বেশিরভাগেরই গন্তব্য হবে বাংলাদেশ। এতে নতুন করে বাংলাদেশকে আরও সংকটে পড়তে হবে।
এদিকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অবস্থা বিবেচনায় প্রস্তুত রয়েছে বাংলাদেশ। দেশটির আর একজন নাগরিকও যেন বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সেজন্য বর্ডার গার্ড বাংলাদেশকে (বিজিবি) সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকতে নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, দুই-তিন দিন ওখানকার (মিয়ানমারের) অভ্যন্তরীণ অবস্থার হয়তো অবনতি হয়েছে। এটা মিয়ানমারের মেটার অব কনসার্ন। কিন্তু এতে যেন বাংলাদেশের বর্ডারে কোনো ইমপ্যাক্ট না পড়ে। অনেকে ভয় করছেন, ওখানে যে পরিমাণ রোহিঙ্গা রয়েছে তারা আবার না বাংলাদেশে চলে আসেন। এ বিষয়টিকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি।
রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বাংলাদেশ প্রস্তুত জানিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বিজিবিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকতে, যেন একজন মিয়ানমারের নাগরিকও আর বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে। আমাদের সংস্থাগুলো আগের চেয়ে অনেক ভালোভাবে প্রস্তুত। আমাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত আছে। যার ভিত্তিতে এজেন্সি, বর্ডার গার্ড, অন্যান্য বাহিনী যারা আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে আছে, তারা এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করবে।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ২০১৬ বা ২০১৭ সালে তাদের (রোহিঙ্গাদের) চলে আসাটা ঠেকাতে পারিনি বা ইনটেনশনালি ঠেকাতেও চাইনি। মানবতার দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাদের জায়গা করে দিয়েছেন। কিন্তু এবার একটা বিষয় আছে, আমাদের কাছে কিছু তথ্য আছে, যেটা ওই সময়ে ছিল না। রাখাইন স্টেটে বেশ কিছু সংবাদ পাচ্ছি। গত ২০ ও ২৮ আগস্ট দুটি কনফার্ম ইনসিডেন্ট হয়েছে। যেখানে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ কোনো কনফ্লিক্টের পার্ট হিসেবে সেখানকার দুটো মর্টার শেল বাংলাদেশের সীমানায় পড়েছিল। তার পরপরই ২১ ও ২৯ তারিখ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এনে প্রতিবাদপত্র দিয়েছি। বিস্তারিত আমাদের যতটুকু আছে জানিয়েছি তাকে।
আগের মতো রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে দলবদ্ধ হয়ে পালিয়ে আসার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমরা মনে করি না এবার এ ধরনের এক্সোডাস হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ হলো-যে লোকেশনে এগুলো ঘটছে, সেখানে এখন সেই অর্থে কোনো রোহিঙ্গা থাকে না। সেখানে হয়তো ইনার ফাইটিং রিভেল গ্রুপ যারা আছে, তাদের অংশ বিশেষ সেখানে থেকে যেতে পারে। ফাইটটা হচ্ছে আমাদের বর্ডারে।
তিনি বলেন, এটা বান্দরবান জেলার আলীকদম উপজেলার নিচে, রাখাইনের নর্থ-ওয়েস্ট কর্নারে এটা হচ্ছে। রোহিঙ্গারা বেশি আছে ইস্টার্ন অঞ্চলে। এ অঞ্চল ক্রস করে তাদের (রোহিঙ্গাদের) বাংলাদেশে ঢোকার কোনো সম্ভাবনা নেই।
মিয়ানমারের উসকানিতে বাংলাদেশ পা দেবে না বলে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, উসকানিতে বা ফাঁদে বাংলাদেশ পা দিতে চায় না। কারণ একটা দিকে নিয়ে যেতে পারলে তাদের একটা স্ট্র্যাটিজিক বেনিফিটস থাকবে। রোহিঙ্গা নিয়ে যে সমস্যাটা এটার একটা দায় আমাদের দিকেও চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হতে পারে।
মংডুতে বসবাসরত কয়েকজন রোহিঙ্গা মোবাইল ফোনে অভিযোগ করে বলেন, আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধের বাহনা করে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করতে চাইছে মিয়ানমার। সেনা সদস্যরা তাদের এলাকাগুলো একে একে ঘিরে ফেলছে। ফেরিসহ সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এলাকা না ছাড়লে ২০১৭ সালের চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে বলেও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গা নেতারাও একই কথা বলছেন। তারা জানান, স্বজনদের সঙ্গে তারা যোগাযোগ রাখছেন। পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। এদিকে সম্প্রতি শতাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পেরিয়ে ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
রোহিঙ্গা প্রতিরোধ ও প্রত্যাবাসন কমিটির সভাপতি উখিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান হামিদুল হক চৌধুরী বলেন, ভারত, সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে রোহিঙ্গারা ক্যাম্পে আশ্রয় নিচ্ছে। মিয়ানমার থেকে নতুন করে রোহিঙ্গা আসলে উখিয়াবাসীর আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো পথ থাকবে না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, রোহিঙ্গারা ইয়াবা ব্যবসা, অস্ত্রবাজি ও সন্ত্রাস, ডাকাতিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে স্থানীয়দের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে। স্থানীয়রা বিপদে আছি। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত সিলগালা করে দেওয়ার দাবি জানান তিনি।
উখিয়া আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উখিয়া সদর রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, রোহিঙ্গারা নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ পেলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। দেশটাই হুমকির মুখে পড়বে। তিনি বলেন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে এ বিষয়ে কঠোর ভাষায় প্রতিবাদ জানানো। আর যা যা করা প্রয়োজন তা সবই দ্রুত করা উচিত।