সুপ্রভাত ডেস্ক »
‘আপত্তিকর’ ভিডিও ফাঁস করার ভয়ভীতি দেখিয়ে টাকা আদায়ের অভিযোগে নয়জনকে গ্রেফতার করেছে অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। পুলিশের এই বিশেষ বিভাগটি বলছে, চক্রটি ‘আপত্তিকর’ ভিডিও ফাঁসের ভয় দেখিয়ে শুধু টাকাই আদায় করত না, এসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রিও করতে। খবর বিডিনিউজের।
গতকাল সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মিয়া মোহাম্মদ আলী বলেন, বছরজুড়ে সিআইডির টিম সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অনলাইনে নজরদারির পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় অভিযানও পরিচালনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় নয়জনকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতাররা হলেন মো. আবু সায়েম ওরফে মার্ক সাকারবার্গ (২০), মো. মশিউর রহমান শুভ (২৬), মো. সাহেদ খান (২২), কেতন চাকমা (২০), মো. নাজমুল হাসান সম্রাট (২২), মো. মারুফ হোসেন (৩৪), শাহরিয়ার আফসান অভ্র (২৪), জুনাইদ বোগদাদী শাকিল (২০) ও মো. জসীম উদ্দীন (৩৮)।
অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করছিলেন, তাদের ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করে ‘পমপম’ নামের একটি টেলিগ্রাম গ্রুপ গোপন ছবি ও ভিডিও হাতিয়ে নিয়ে ব্লাকমেইল করছে, অর্থ দাবি করছে। অর্থ দিতে না পারলে ভিডিও কলে এসে আপত্তিকর কর্মকা- করতে বাধ্য করছে আর কোনো প্রস্তাবে সাড়া না দিলে ভুক্তভোগীদের নাম-পরিচয় আর ব্যক্তিগত তথ্য টেলিগ্রাম গ্রুপগুলোতে ভাইরাল করে দিচ্ছে।
‘এই অভিযোগের ভিত্তিতে সিআইডির সাইবার পুলিশের একটি দল দেখতে পায় গ্রুপটি আপত্তিকর ভিডিও ভাইরাল করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে যে কেবল টাকা আদায় করে তাই নয়, চক্রটি ওইসব ভিডিও দেশে-বিদেশে বিক্রি করেও কোটি টাকা আয় করেছে।’
তিনি বলেন, মাসে এক থেকে দুই হাজার টাকা সাবস্ক্রিপশন ফি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, পর্তুগাল, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র এবং ইংল্যান্ডের মত দেশের অসংখ্য মানুষ গ্রুপটির সদস্য হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, চক্রটির নেতৃত্ব দেন আবু সায়েম, যিনি ‘মার্ক-সাকারবাগ’ নামে গ্রুপে পরিচয় দেন। ২০ বছর বয়সী এই তরুণ শ্যামলী পলিটেনিক ইনস্টিটিউট ও চট্টগ্রাম থেকে ইলেকট্রিক্যালে ডিপ্লোমা করেছেন। তার বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে কোটি কোটি টাকা লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে।
ডিএমপির তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার একটি মামলা তদন্তে নেমে সায়েমকে নগরীর লালখান বাজার এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তার দুই বন্ধু শাহরিয়ার আফসান অভ্রকে চট্টগ্রামের হাউজিং এলাকা থেকে এবং বোগদাদী শাকিলকে উখিয়া থেকে গ্রেফতার করা হয়।
সিআইডি প্রধান মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সায়েমের মোবাইল ফোনে ‘মার্ক-সাকারবার্গ’ আইডিটি লগইন অবস্থায় পাওয়া যায় এবং নিশ্চিত হওয়া যায় যে, আবু সায়েমই ‘মার্ক সাকারবার্গ’। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে ‘পমপম’ গ্রুপের যতগুলো চ্যানেল এবং গ্রুপ আছে তার এডমিনদের আসল নাম-পরিচয় পাওয়া যায়।
‘এডমিনদের কাজ ছিল সায়েমের হয়ে নতুন নতুন কন্টেন্ট যোগাড় করা। নতুন কন্টেন্ট পেতে তারা ফেইক এনআইডি বানিয়ে টার্গেটের ফেইসবুক বা ইনস্টাগ্রাম আইডি হ্যাক করত। নতুন কনটেন্ট পেতে চক্রটির এখন এত কষ্ট করতে হচ্ছে না। কারণ ভুক্তভোগী তরুণীদের সাবেক প্রেমিকেরাই নতুন নতুন কন্টেন্ট দিচ্ছে।
‘অর্থাৎ সুসময়ে প্রেমিকার যেসব অন্তরঙ্গ মুহূর্ত তারা ক্যামেরাবন্দি করেছে, সেগুলোই প্রতিশোধের নেশায় তুলে দেয় মার্ক-সাকারবার্গদের গ্রুপে। মার্ক তার এডমিনদের দিয়ে সেগুলোতে মিউজিক বসিয়ে, ফেইসবুক আইডি থেকে ছবি নিয়ে ৩০ থেকে ৪০ সেকেন্ডের প্রমো বানিয়ে আপলোড করে তার গ্রুপগুলোতে। প্রমো দেখে যারা ফুল-ভার্সন দেখতে চায়, তাদের এক থেকে ২ হাজার টাকার প্রিমিয়াম সার্ভিস কিনতে হয়।
মোহাম্মদ আলী বলেন, সায়েম, অভ্র এবং শাকিলকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং তাদের ডিভাইস তল্লাশি করে মার্ক-সাকারবার্গের বিভিন্ন পেইজের এডমিনদের আসল পরিচয় উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে।
‘তার (সায়েম) সবচেয়ে বিশ্বস্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সহযোগী ডিটিআর শুভ ওরফে মশিউর রহমান। মশিউরের দায়িত্ব ছিল গ্রুপ থেকে কৌশলে কন্টেন্ট সেভ করে রাখা একং নানা প্রলোভনে তরুণীদের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ভিডিও হাতিয়ে নেওয়া।’
মশিউর চট্টগ্রামের একটি ফিশিং কোম্পানিতে চাকরি করেন। অবস্থান নিশ্চিত হয়ে তাকে কর্ণফুলি এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় তার সহযোগী জসীমকেও।
সিআইডি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সায়েম এবং মশিউরকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায় এই গ্রুপগুলোর এডমিনদের অনেকেই ঢাকায় অবস্থান করছে। ফলে তাদের বেইলি রোড এলাকার একটি রেস্টুরেন্টে গেট টুগেদারের ফাঁদ পাতা হয়। ফাঁদে পা দিয়ে একে একে গ্রেপ্তার হয় গুরুত্বপূর্ণ এডমিন ক্যাকটাস ওরফে কেতন চাকমা, এল ডোরাডো ওরফে শাহেদ, তূর্য ওরফে মারুফ এবং মিঞা ভাই ওরফে নাজমুল সম্রাট।’
সায়েম এবং তার সহযোগীদের গ্রুপ ও চ্যানেলগুলোয় সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় সোয়া চার লাখ। আর সেগুলোতে ২০ হাজার আপত্তিকর ভিডিও এবং প্রায় ৩০ হাজার কন্টেন্ট রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।
তাদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থার কোনো বিকল্প নেই মন্তব্য করে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘এ ঘটনায় মানিলন্ডারিংয়ের বিষয়টিও তদন্ত করার পরিকল্পনা করেছি। তাহলে কেবল টেলিগ্রাম চক্রের হোতারাই নয়, তাদের দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে থাকা সহযোগীদেরও আইনের আওতায় আনা যাবে।’