হুমাইরা তাজরিন »
শিক্ষার আলোয় আলোকিত না হলে মানুষের জীবন যেন অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়। আর মানুষকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার কারিগর শিক্ষকেরা। সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে অদ্যাবধি তাঁদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯৯৫ সাল থেকে ইউনেস্কো প্রতি বছর ৫ অক্টোবর পালন করছে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’।
১৯৬৬ সালে ইউনেস্কো এবং আইএলও ‘শিক্ষকদের অবস্থা’ সম্পর্কিত একটি সুপারিশ পেশ করে। যেখানে সারা বিশ্বের শিক্ষকদের নীতি, নিয়োগ ও প্রাথমিক প্রশিক্ষণের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি তাদের শিক্ষা অব্যাহত রাখা, কর্মসংস্থান এবং কাজের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর রূপরেখা দেয়। ১৯৯৪ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ( আইএলও) ও জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো দ্বারা সুপারিশে স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৪ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর সাধারণ ২৬তম অধিবেশনে সংস্থার তৎকালীন মহাপরিচালক ফ্রেডারিক এম মেয়র এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের অনুরোধে ৫ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসের লক্ষ্য হলো বিশ্বের শিক্ষাবিদদের প্রশংসা করা, মূল্যায়ন করা এবং তাদের উন্নয়নে সহায়তা করা। শিক্ষা এবং শিক্ষকের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো মূল্যায়ন করা। বিশ্বের ১শ’ টিরও বেশি শিক্ষক দিবসকে স্মরণ করে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘আমরা যেমন শিক্ষা চাই তার জন্য আমাদের শিক্ষকদের প্রয়োজন: বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের ঘাটতি দূর করা অপরিহার্য’।
ইউনেস্কোর মতে, শিক্ষকেরা শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু হলেও অনেক দেশে শিক্ষকেরা তাদের পছন্দের পেশা ছেড়ে যাচ্ছে এবং খুব কম সংখ্যক তরুণ কিংবা যুবকরা শিক্ষক হতে চায়। ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ কোটি ৯০ লক্ষেরও বেশি নতুন শিক্ষকের প্রয়োজন এবং এই ঘাটতি কেবল বাড়ছেই। এর মধ্যে সর্বজনীন মৌলিক শিক্ষা অর্জনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষায় ২৪ কোটি ৪ লক্ষ এবং মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য প্রায় ৪৪ কোটি ৪ লক্ষ শিক্ষকের প্রয়োজন।
২০২২ সালে বিশ্ব শিক্ষক দিবসের জন্য উন্মোচিত ইউনেস্কোর পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, সাহারাÑনি¤œ আফ্রিকায় প্রাথমিক স্তরে ৫৪ লক্ষ এবং মাধ্যমিক স্তরে ১ কোটি ১১ লক্ষ শিক্ষক প্রয়োজন। সেখানে দ্বিতীয় বৃহত্তম ঘাটতিযুক্ত অঞ্চল হিসেবে উল্লেখ করা হয় দক্ষিণ এশিয়ার নাম। যেখানে প্রাথমিক স্তরে ১৭ লক্ষ এবং মাধ্যমিক স্তরে ৫৩ লক্ষ অতিরিক্ত শিক্ষকের প্রয়োজন।
ইউনেস্কোর মহাপরিচালক অড্রে আজৌল বলেন,‘ প্রশিক্ষণের অভাব,কাজের অপ্রতুলতা, অপর্যাপ্ত তহবিল সবই শিক্ষকতা পেশাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বিশ্বব্যাপী শিক্ষা সংকটকে আরো বাড়িয়ে দেয়। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যত নির্ভর করে এই পেশার উপর। তাই এই পেশা সম্পর্কে সচেতন হওয়া আমাদের জন্য জরুরি।’
আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে উন্নয়নের জন্য নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যেমন বিনামূল্যে বইবিতরণ, স্বল্প সময়ে ফলাফল ঘোষণা, উপবৃত্তি প্রদান, ১৪ হাজার প্রতিষ্ঠানে শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, প্রাথমিক শিক্ষায় শতভাগ ভর্তি, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন, বিভিন্ন জেলাতে বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত সংস্কার ও উন্নয়ন , ২৬ হাজার ১৯২টি বিদ্যালয়ের ১ লক্ষ ৪ হাজার শিক্ষককে জাতীয়করণ এবং এনসিআরসির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি।
চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি রাজধানীর সোনার গাঁও হোটেলে ‘গ্লোবাল এডুকেশন মনিটরিং রিপোর্ট ’ তুলে ধরতে গিয়ে প্রতিবেদনটির পরিচালক ম্যানোস আন্তোনিনিস বলেন,‘ বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে অর্থায়ন পর্যাপ্ত নয়। সেখানে সমতার অভাব রয়েছে। বাংলাদেশের শিক্ষকদের বেতন কাঠামো মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিতের জন্য যথেষ্ট নয়। সরকারের উচিত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য এমন একটি মানদ- নির্ধারণ করা।’
এই প্রতিবেদনের মতে, মহামারিকালে সরকারি শিক্ষকেরা বেতন পেলেও বেসরকারি শিক্ষকেরা পেয়েছেন তাদের বেতনের ৮০ থেকে ৬০ শতাংশ। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও প্রাইভেট-কোচিংয়ের দারস্থ হয় শিক্ষার্থীদের। তবে এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলের অভিভাবকদের। এর হার ৬৭ শতাংশ। উচ্চ আয়ের সন্ধানে আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে অনেক মেধাবী শিক্ষক এই ‘ছায়া শিক্ষায়’ চলে গেছেন বলে জানা যায়।
জানা যায়, বাংলাদেশ সরকার ৩৪তম নন ক্যাডার বিসিএসে ৮৯৮জন এবং পরে ৩৬তমের মাধ্যমে ৩৫০ জনকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এটি দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার একটি পদ কিন্তু নিয়োগপ্রাপ্তদের কমপক্ষে ৬০ শতাংশ পরে চাকরি ছেড়ে দেন। মূলত যথাযোগ্য সামাজিক মর্যাদার অভাব ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবের ফলে তারা চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। ৪০ তম বিসিএসে ১হাজার ৯শ’ ৩টি পদের বিপরীতে আবেদন পড়েছিল ৪ লক্ষ ১২ হাজার। কিন্তু তাদের ১ শতাংশেরও কম প্রথম পছন্দের পদ হিসেবে সাধারণ শিক্ষায় আবেদন করেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও প্রায়ই একই চিত্র, পাশ্ববর্তী দেশের তুলনায় দেশীয় শিক্ষকদের রয়েছে বেতনের কাঠামোর বিস্তর ফারাক এবং আবাসানের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সংকট। যার ফলে দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের মধ্যে বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতাও বাড়ছে। কেননা দেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করে তারা যে সম্মান ও সম্মানী পাবেন তারচেয়ে বেশ কয়েকগুণ বেশি সম্মান ও সম্মানি পাবেন বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলে।
অথচ ফিনল্যান্ডে শিক্ষকতায় আসেন দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক হওয়ার আগে তাদের করতে হয় বিশেষ কোর্স। সেই কোর্সে যারা সবচেয়ে ভালো করেন তারা সুযোগ পান প্রাথমিকে, এরপর মাধ্যমিকে এবং সবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকের মর্যাদা এবং বেতন একইভাবে নিরূপিত হয়। এই সুশৃঙ্খল নীতির কারণে সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে বিশ্বে শ্রেষ্ঠ বলা হচ্ছে।’
তাই ইউনেস্কোর এবারের প্রতিপাদ্য অনুযায়ী বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শিক্ষকদের ঘাটতি পূরণের জন্য নানাবিধ উদ্যোগের তাগিদে পালিত হবে ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’।