আনোয়ারা গণহত্যা

আয়েন উদ্দীন »

‘যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে যায়, পরিশ্রান্ত ক্লান্ত মানুষের ভাগ্যে জোটে করের বোঝা, রাশি রাশি বিধবা আর কাঠের পা ও ঋণ।’ কথাটা বলেছিলেন ফ্রান্সিস মুর। কাঠের পাÑ যে পা’কে মনে হবে অচেতন, বোধহীন, প্রতিটি কদমে পাগুলো কাঠ হয়ে আসতে চায়। যুদ্ধে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একা দুইটি পায়ের উপর দাঁড়াতে হবে তখন ভাবুন তো! সেই পায়ের ওজন মাপার কোন পাল্লা এই পৃথিবীতে পাওয়া যাবে কিনা!
দিনটি শুক্রবার। ১৯৭১ সালের ২১ মে দিনটি শুক্রবার ছিল কিনা জানা নেই। তবে ২১ মে একটি পাড়ার কাছে, একটি পরিবারের কাছে, একজন মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।
শহরে থেকে ৪০/৫০ মিনিট গাড়িতে চড়লে আজকে পৌঁছে যেতে পারি আনোয়ারার তখনকার জমিদার পল্লীতে। পরৈকোড়া, পূর্বকন্যারা ও বাথুয়া পাড়া এই তিন গ্রামকেই বলা হতো জমিদার পল্লী। ১৯৭১ সালের ২১ মে গণহত্যা চলে এই পল্লীতে। এই দিনে পাকিস্তানি হানাদাররা তিনটি গ্রামে ১৭৬ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে।
‘২১ মে সকাল ৯ টার দিকে পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের দোসররা হামলে পড়ে গ্রামে। জমিদার যোগেশ বাবুর বাড়িতে ঢোকার পূর্বমুহুর্তে পারুল কুসুম রায়সহ পরিবারের সকল সদস্য পশ্চিম গেইট দিয়ে ধানক্ষেতে আশ্রয় নেয়। শুরু হয়ে যায় গ্রামজুড়ে পাকিস্থানি হানাদার ও তাদের দোসরদের লুটপাট, জ্বালাও, পোড়াও উল্লাস। পাকিস্তানি বাহিনী জমিদার যোগেশ বাবুর বাড়িতে প্রবেশ করে উত্তর উত্তর দক্ষিণে লম্বা কাঁচা-পাকা বিশাল ঘরটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় …। (আনোয়ারা একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযোদ্ধ, জামাল উদ্দীন)
সেই দিনের ভয়াবহতার সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা সুরজিৎ দাশ শানু। সেদিন তিনি হারিয়েছিলেন তাঁর বাবাসহ পরিবারের পাঁচজনকে। সেই দিনের কথা বলতে বলতে চোখে জল আসে তাঁর। কিছুক্ষণ চুপ থাকেন। আবার বলতে থাকেন। এইভাবে ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেনÑ ‘আমরা প্রতিদিন মুরালী খালের পাড়ে পাহারা দিতাম। ২০ মে সত্তার (এম এন এ জামালুস ছত্তার) সাহেব খবর পাঠিয়েছিলেন ২১ মে পাকিস্তানিরা হামলা করতে পারে। সারারাত পাড়ার কেউ ঘুমায়নি। পাড়া পাহারা দিয়েছিলাম। ২১ মে সকাল বেলা পাকিস্তানির পাড়ায় আসে। সব ঘর বাড়ি পুড়ে দেয়। আমাদের তেমন কোন অস্ত্র ছিল না। আমি নদীতে ডুব দিয়ে অপর পাড়ে গিয়ে রক্ষা পেয়েছিলাম। আমার বাবা ও পরিবারের সদস্যদের যখন হত্যা করে তখন দুপুর ২ টা। বিকেলে বাড়িতে গিয়ে দেখি সব লাশ।’
কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। আবার তীক্ষè কণ্ঠে বলে উঠলেনÑ ‘খায়ের আহম্মদ চৌধুরী (খরাতি মিয়া) পাড়ায় পাকিস্তানিদের নিয়ে আসছিলেন। পাড়ায় পাকিস্তানীরা দুই শতাধিক নিরীহ মানুষকে হত্যা করছিলেন। কিন্তু এখন সেই রাজাকারের নামে রাস্তা হলো।’
লেখার শুরুতে একটি শব্দ লিখেছিলাম ‘ঋণ’। রাজাকারের নামে স্বাধীন দেশে সড়কের নামকরণ করে আমরা ঋণ আরো বাড়িয়ে তুললাম।

লেখক : সাংবাদিক