ড. মোহাম্মদ অহিদুল আলম
ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতি হচ্ছে সমুদ্রের জলরাশি ও তলদেশে বিভিন্ন সম্পদকে কাজে লাগানোর তাগিদে সমুদ্র সম্পদ-নির্ভর অর্থনীতি। এই অর্থনীতি মূলত একটি দেশের সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার ও সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমুদ্র সম্পদের অন্বেষণ ও আহরণকে বোঝায়।
টেকসই সমুদ্র অর্থনীতি ভবিষ্যতে বিশ্বের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা করবে। জাতিসংঘ মতে, মহাসাগর, সাগর ও উপকূলীয় অঞ্চলের সাথে সম্পর্কিত সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সমুদ্র অর্থনীতির অংশ। সমুদ্র সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলোর খাদ্য নিরাপত্তা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণের পরিপূরক হিসেবে ব্লু ইকোনোমি অবদান রাখবে বলে সংস্থাটি মনে করে। তাছাড়া টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ১৪ নম্বরে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অঞ্চলগুলোর সামুদ্রিক সম্পদের সংরক্ষণ, ব্যবহার ও ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার দাবি জানানো হয়েছে। এ বছর বিশ্ব অর্থনীতি ফোরামেও ব্লু-ইকোনমিকে প্রাধান্যে দিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে। সামগ্রিকভাবে টেকসই সামুদ্রিক মাছ আহরণ, জাহাজ মেরামত ও জাহাজ নির্মাণ, উপকূলীয় তেল ও গ্যাসক্ষেত্র, লবণ চাষ, মৎস্য বন্দর, উপকূলীয় পর্যটন, সমুদ্র পরিবহন ও নব বন্দর ইত্যাদিকে সুনীল অর্থনীতির পরিসর হিসেবে গণ্য করা হয়।
বাংলাদেশেরও অর্থনৈতিক উন্নয়ননে সুনীল অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে। যেহেতু বিশ্বের ৪৩০ কোটি মানুষের ১৫ ভাগ প্রোটিনের যোগান দিচ্ছে সামুদ্রিক মাছ, উদ্ভিদ ও প্রাণি এবং পৃথিবীর ৩০ ভাগ গ্যাস ও জ্বালানি তেল সরবরাহ হচ্ছে সমুদ্রের বিভিন্ন তেল ও গ্যাসক্ষেত্র হতে, সেহেতু বাংলাদেশেও প্রোটিনের পর্যাপ্ত সরবরাহ বৃদ্ধি ও জ্বালানি সুরক্ষার জন্য ব্লু ইকোনমির গুরুত্ব অপরিসীম।
সমুদ্র অর্থনীতিকে গতিশীল করার জন্য বাংলাদেশ একটি প্রতিশ্রুতিশীল দেশ হতে পারে। স্বাধীনতার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে সমুদ্র অর্থনীতিকে সামনে রেখে টেরিটোরিয়াল ওয়াটার অ্যান্ড মেরিটাইম এক্স আইনটি পাশ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৪ সালে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের আলোচনা শুরু হয়। ২০১২ সালে মায়ানমার ও ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা মীমাংসার মাধ্যমে সমুদ্র বিজয়ের পরেই মূলত বাংলাদেশের সমুদ্র অর্থনীতি কাজে লাগানোর বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ব্লু- ইকোনমি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য ব্লু ইকোনমি সেল গঠন করে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় ইকোনমিবিষয়ক আন্তর্জাতিক কর্মশালায় বাংলাদেশে সমুদ্রনির্ভর অর্থনৈতিক কার্যক্রমকে গতিশীল করার মাধ্যমে উপকূলের লোকজনের বেকারত্ব দূর করার জন্য নতুন দিগন্ত সূচনার তাগিদ দিয়েছেন।
বিশ্ব অর্থনীতিতে বছরে তিন থেকে পাঁচ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের কর্মকাণ্ড সংগঠিত হচ্ছে সমুদ্র সম্পদকে ঘিরে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য মতে ২০১৪-১৫ সালে বাংলাদেশ সমুদ্র অর্থনীতি বাবদ আনুমানিক ৬১৯২.৯৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্জন করেছে যা বাংলাদেশ জাতীয় অর্থনীতির সাথে প্রায় ৩.৩৩ শতাংশ। বর্তমানে সেটি ৪ শতাংশের চেয়েও বেশি।
মৎস্য আহরণ, জাহাজ চলাচল ও জাহাজ ব্যবস্থাপনা, বন্দর এবং সামুদ্রিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সহায়ক পরিষেবা, সামুদ্রিক জৈব প্রযুক্তি, খনিজ পদার্থ, সামুদ্রিক নবায়নযোগ্য শক্তি, সামুদ্রিক পণ্য, সামুুদ্রিক পর্যটন ও অবকাশ, সামুদ্রিক স্থাপনা ও নির্মাণ, সামুদ্রিক বাণিজ্য, সামুদ্রিক তত্ত্ব ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, সামুদ্রিক শিক্ষা ও গবেষণা ইত্যাদি ক্ষেত্রসমূহ বাংলাদেশে সুনীল অর্থনীতি অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ও সম্ভাবনাময়। তাছাড়া বঙ্গোপসাগরে সমুদ্র সম্পদের ব্যবহারের মাধ্যমে আগামীদিনে জ্বালানি নিরাপত্তা বাংলাদশের সামগ্রিক অর্থনীতির চেহারা বদলা দিতে পারে। এমনকি সামুদ্রিক খাদ্যপণ্য রপ্তানি করেও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব। যেমন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বঙ্গোপসাগর হতে বছরের প্রায় ৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরা সম্ভব, যেখানে বর্তমানে আমরা মাত্র ০.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন মাছ ধরতে পারছি।
বিভিন্ন দেশে সামুদ্রিক বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণি হতে কসমেটিক ও ওষুধ তৈরি হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে বিভিন্ন সামুদ্রিক শৈবাল হতে ওমেগা-৩ ও ওমেগা-৬ নামের এন্টিঅক্সিডেন্টসমূহ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। মেরিন জৈব প্রযুক্তির মাধ্যমে সামুদ্রিক শৈবাল হতে বায়োডিজেল উৎপাদন এবং বিদ্যমান মৎস্য সম্পদের উন্নয়ন সম্ভব। তাছাড়া লবণ চাষে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যমান প্রায় ১৫ লাখ মেট্রিক টনের বেশি লবণ উৎপাদন সম্ভব। বঙ্গোপসাগরের খনিজ পদার্থ যেমন টাইটানিয়াম অক্সাইড, কোবাল্ট, ম্যাগনেটাইটসহ অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদসমূহ উত্তোলন করা গেলে কোটি কোটি মার্কিন ডলার আয় করা সম্ভব।
গভীর সমুদ্র নির্মাণ, উন্নত মানের বাণিজ্য জাহাজ নির্মাণ, ছোট বড় শিপইয়ার্ড তথা বন্দরের সুবিধা আন্তর্জাতিক মানের করার লক্ষ্যে দ্রুত গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা প্রয়োজন। নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সমুদ্রের ঢেউ ও জোয়ার ভাটাকে কাজে লাগানোর মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও পরীক্ষামূলক কার্যক্রম চালু করা জরুরি। উপকূলীয় পর্যটন ক্রজশিপের মাধ্যমে ভ্রমণের ব্যবস্থা ও কৃত্রিম দ্বীপ সৃষ্টির মাধ্যমে এই অঞ্চলে বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ট করানোর জন্য গবেষণা কার্যক্রম তড়িৎ গতিতে এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।
ব্লু ইকোনমির জন্য পর্যাপ্ত নীতিমালা ও সঠিক কর্মপরিকল্পনাসহ দক্ষ জনশক্তি এবং প্রযুক্তিগত জ্ঞানের সক্ষমতা অর্জন করা গেলে ভবিষ্যতে ব্লু ইকোনমি বা সুনীল অর্থনীতিতে দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের মধ্যে একটি অপার সম্ভাবনাময় দেশ হিসেবে নিশ্চিত এগিয়ে যাবে বাংলাদেশে।
লেখক : সভাপতি, ওশানোগ্রাফি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।