এস ডি সুব্রত »
সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে বিদ্রোহের এক অমরকাব্য কবি নজরুলের সাড়াজাগানো ‘অগ্নিবীণা’। বিদ্রোহ আর ভাঙনের আহ্বান অগ্নিবীণা কাব্যে ধ্বনিত হয়েছে ঘুণেধরা সমাজকে জাগিয়ে তুলতে। পরাধীনতার বন্ধন থেকে মুক্তির প্রত্যাশায় সচেতন ভারতবাসী যখন হয়েছে কঠিন সংগ্রামী ঠিক তখনই ‘অগ্নিবীণা’য় বিদ্রোহের ঝড় তুললেন নজরুল। মানুষ ও মানবতার পক্ষে তিনি উচ্চারণ করেছেন বিদ্রোহের বাণী। সত্য ও সুন্দরের জন্য তিনি এই বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। অপশক্তি, ধর্মীয় শোষণ আর তথাকথিত শাস্ত্রাচার আর ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিল তাঁর এই দ্রোহ।
শতবর্ষ আগে ১৯২২ সালে বাংলা কবিতা ও গানের চলমান ধারায় প্রবল প্রকম্প সৃষ্টি করে জ্বলে উঠেছিল অগ্নিগিরির জ্বালামুখÑ যার নাম ‘অগ্নিবীণা‘। এটি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম প্রকাশিত কাব্য, বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা অবদান।
১৩২৯ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাসে (অক্টোবর, ১৯২২ খ্রিস্টাব্দ) প্রকাশিত হয় ‘অগ্নিবীণা’। গুন্থটির উৎসর্গপত্রে লেখা ছিল : ‘বাঙলার অগ্নিযুগের আদি পুরোহিত সাগ্নিক বীর শ্রীবারীন্দ্র কুমার ঘোষÑ শ্রীশ্রীচরণারবিন্দেষু।’ নিচে লেখা আছে : ‘তোমার অগ্নিপূজারী- হে মহিমাম্বিতÑ শিষ্য কাজী নজরুল ইসলাম।’
এ বছর ‘অগ্নিবীণা’ প্রকাশের শতবর্ষপূর্ণ হলেও এ কাব্যের শতবর্ষ আগের মতো মানুষ এখনো স্বাধীনতার পূর্ণস্বাদ হতে বঞ্চিত। এখনো বিশ্বে ‘উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল’ শোনা যায়।
নজরুলের সবচেয়ে বেশি পঠিত কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’। আর এই কবিতাটি যে বইয়ে সংকলিত করা হয়েছে তার নাম ‘অগ্নিবীণা’।১৯২২ সালে মাত্র ২৩ বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর অমর এই কাব্যটি। এই গ্রন্থে মোট বারোটি কবিতা আছে। কবিতাগুলি হচ্ছে : ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘বিদ্রোহী’, ‘রক্তাম্বর-ধারিণী মা’, ‘আগমনী’, ‘ধূমকেতু’, কামাল পাশা’, ‘আনোয়ার’ ‘রণভেরী’, ‘শাত-ইল-আরব’, খেয়াপারের তরণী’, কোরবানী’ ও ‘মোহররম’। ‘অগ্নিবীণা’ প্রচ্ছদপটের পরিকল্পনা ছিল অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এবং এঁকেছিলেন তরুণ চিত্রশিল্পী বীরেশ্বর সেন। বারোটি কবিতা দিয়েই নজরুল সে সময়ে বুঝিয়ে দেন তাঁর কবিত্বশক্তি। বইয়ের দ্বিতীয় কবিতাটিই হচ্ছে ‘বিদ্রোহী’। যা নজরুলকে খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে নিয়ে গেছে। কবিতাটি ব্যাপকভাবে আলোচিত এবং সমালোচিত হয়। যখন কবি বলতে সবাই রবীন্দ্রনাথকেই বুঝতো, তখন রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে এসে সম্পূর্ণ ভিন্নধারার কবিতা নিয়ে হাজির হলেন কাজী নজরুল। ‘অগ্নিবীণা’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতায় অনুপ্রাস, উপমা, রূপক এবং ছন্দপ্রয়োগে অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন নজরুল।
‘প্রলয়োল্লাস’ কবিতায় কবির উচ্চারণ :
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
ঐ নূতনের কেতন ওড়ে কাল্-বোশেখির ঝড়।
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
কবি যেমন ছিলেন চিরনতুন ও চঞ্চল, তেমনি নতুনদের আহ্বান জানিয়েছেন নবছন্দে :
ঐ ভাঙা-গড়া খেলা যে তার কিসের তবে ডর?
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
বধূরা প্রদীপ তুলে ধর!!
কাল ভয়ঙ্করের বেশে এবার ঐ আসে সুন্দর!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
তোরা সব জয়ধ্বনি কর!!
কবিতাটিতে কবি নতুনের জয়গানে মুখর হয়েছেন। কবি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, নতুনেরাই পারে নবকিছু সৃিিষ্ট করতে। নজরুল তাঁর বিখ্যাত ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় বলছেন :
বল বীর
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির
বল বীর
বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’ চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা ছাড়ি’
ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া
খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,
উঠিয়াছি চির বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর!
‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কবি অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কিভাবে জ্বলে উঠতে হয়, তাই বলেছেন কবিতার পঙক্তিগুলোতে। বিদ্রোহের পাশাপাশি কবিকে আমরা দেখতে পাই প্রেমিকরূপেও। কবি বলেন :
মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য …
প্রেমিক রূপকে ছাপিয়ে বিদ্রোহীরূপই মুখ্য হয়ে ফুটে উঠেছে ‘বিদ্রোহী’ কবিতায়। কবির বিদ্রোহ ঘুণে ধরা সমাজ, পুঁজিবাদী রাষ্ট্র ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। যে মুসলিম জাতি একদিন অপ্রতিরোধ্য ছিল, যাঁদের বীরত্বের কথা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ইতিহাসের পাতায়-পাতায়, তাঁদের দৈন্যদশা কবিকে দারুণভাবে আহত করেছিল। তাই তিনি ধিক্কার জানিয়েছেন মুসলিম নামধারী পথভোলা নেতাদের। কবি মুসলিম জাতির দুঃখ-দুর্দশা দেখে আক্ষেপ করে ‘আনোয়ার’ কবিতায় বলেন :
আনোয়ার! আনোয়ার!
যে বলে সে মুসলিম জিভ ধরে টানো তার!
বেইমান জানে শুধু জানটা বাঁচানো সার!
আনোয়ার! ধিক্কার!
কাঁধে ঝুলি ভিক্ষারÑ
তলওয়ারে শুরু যার স্বাধীনতা শিক্ষার!
যারা ছিল দুর্দ্দম আজ তারা দিকদার!
আনোয়ার! ধিক্কার!
‘ধূমকেতু’ কবিতায় নজরুলকে আমরা দেখতে পাই আরও বেশি সাহসী হিসেবে :
আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃমহাবিপ্লব হেতু
এই স্রষ্টার শনি মহাকাল ধূমকেতু!
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। সঠিক শব্দচয়নের মাধ্যমে ‘অগ্নিবীণা’র প্রত্যেকটি কবিতায় ছন্দালংকার এবং অর্থালংকারের সার্থক প্রয়োগ ঘটিযেছেন কবি। পঙক্তিবিন্যাসেও দেখিয়েছেন মুনশিয়ানা, নতুনত্ব। বীণাতে সুর উঠিয়ে গায়ক আনন্দের, বিরহের গান গায় কিন্তু নজরুল দেখালেন যে, বীণাতে অগ্নিমাখা সুর তুলে জালিমের বুকে কাঁপনও তোলা যায়।
শতাব্দীকাল ধরেই ‘অগ্নিবীণা’ বাংলা সাহিত্যে অন্যতম সেরা কাব্যগ্রন্থ। ‘অগ্নিবীণা’ যে কেবল কয়েকটি কবিতার সংকলন, তা নয়। এটা একটি জাতির আবেগ, ইতিহাস, স্বকীয়তা, আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক। ‘অগ্নিবীণা’ হচ্ছে চরম স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রথম সাহসী কাব্যিক উচ্চারণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে মসজিদের পাশে শুয়ে আছেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। কিন্তু তিনি আজও বেঁচে রয়েছেন তাঁর অনন্যসাধারণ সৃষ্টির মাধ্যমে মানুষের অন্তরে। ‘অগ্নিবীণা’র গুরুত্ব বাংলা সাহিত্যে অত্যধিক। জনপ্রিয়তার দিক থেকে এ কাব্যগ্রন্থের সঙ্গে তুলনাযোগ্য খুব কম গ্রন্থই বাংলা সাহিত্যে পাওয়া যাবে। রবীন্দ্রসাহিত্যের স্বর্ণযুগে নজরুলকে স্বতন্ত্র কবির মর্যাদা এনে দিয়েছে এই গ্রন্থ। সাহিত্যের আসরে স্থায়ী আসন নিতে অনেক কবিকেই দীর্ঘকাল সাধনা করতে হয়েছে। নজরুল সেই আসনটি অধিকার করেছেন অতি অল্পকালের মধ্যে, যার মূলে রয়েছে ‘অগ্নিবীণা‘ কাব্যগ্রন্থ। এই কাব্যের মাধ্যমেই নজরুলের কলমে নতুন যুগের বারতা ঘোষিত হয়। পরাধীন জাতির তিমিরাচ্ছন্ন ভাগ্যাকাশে দীপ্তিমান সোনালি সূর্য ‘অগ্নিবীণা’।
বাংলা সাহিত্যে যুগোত্তীর্ণ কবিতাগ্রন্থগুলোর অন্যতম এটি। এটি হয়ে আছে বাংলা সাহিত্যের সেরা জনপ্রিয় কাব্যগ্রন্থ। নজরুল পরিণত হন যুগের মহানায়কে। সেই সময়ে এই কাব্যের দুটি কবিতার জন্য নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয় এবং কুমিল্লা থেকে কবিকে গ্রেপ্তার করা হয়। স্বাধীনতা ও স্বাধীনচেতনার সপক্ষে এটিই কোনো বাঙালি কবির প্রথম কারাবরণ। ১৯২৩ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ আদালত নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদ- প্রদান করে। নজরুল ছাড়া পান ১৯২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। এই ‘অগ্নিবীণা’রই অন্যতম সংযোজন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। রবীন্দ্রসাহিত্যের স্বর্ণযুগে নজরুলকে স্বতন্ত্র যুগস্রষ্টা কবির মর্যাদা এনে দেয় এই কবিতা।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতা রচনারও আলাদা একটি প্রেক্ষাপট আছে। সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেই নজরুল বুঝতে পারেন পরাধীনতার গ্লানি কতটা ভয়ঙ্কর করে তুলেছে সাহিত্যের অঙ্গনকে। সেই প্রেক্ষাপটে নজরুল রচনা করেন ‘বিদ্রোহী’। ‘অগ্নিবীণা’য় প্রকাশের আগে ১৯২২ সালের জানুয়ারি মাসে কবিতাটি প্রকাশিত হয় সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায়। শুরুতেই কবিতাটি অসাধারণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। গ্রন্থভুক্ত হওয়ার পূর্বেই সমগ্র বাঙালি পাঠকের কাছে পৌঁছে যায় এ কবিতা। ‘অগ্নিবীণা’র প্রথম সংস্করণের প্রকাশক ছিলেন স্বয়ং গ্রন্থকার। দু’হাজার কপি ছাপা হয়। গ্রন্থটি প্রকাশের পর নজরুল ‘রাজদ্রোহ-অপরাধে’ কারাগারে বন্দি হন। স্বাধীনতার সামগ্রিক আকাক্সক্ষায় আন্দোলিত বিদ্রোহী চেতনার স্ফুরণ ঘটেছে কবিতাটিতে। একটা জাতির অবদমিত বিপন্নপ্রায় সত্তা যেন নড়ে উঠেছে কবিতাটির তরঙ্গায়িত প্রতিটি পংক্তিতে ।
‘খেয়াপারের তরণী’ কবিতায় আধ্যাত্মিক চেতনা বলিষ্ঠ কণ্ঠে শোনা যায় :
নাচে পাপ-সিন্ধুতে তুঙ্গ তরঙ্গ!
মৃত্যুর মহানিশা রুদ্র উলঙ্গ!
নিঃশেষে নিশাচর গ্রাসে মহাবিশ্বে,
ত্রাসে কাঁপে তরণীর পাপী যত নিঃস্বে।
‘কোরবানী’ কবিতায় কোরবানির স্বরূপ উন্মোচন করেছেন এভাবে :
ওরে হত্যা নয় আজ সত্যাগ্রহ শক্তির উদ্বোধন!
দুর্ব্বল! ভীরু! চুপ রহো, ওহো খামখা ক্ষুব্ধ মন!
নজরুলের ‘অগ্নিবীণা’ তাই আজো বাংলা সাহিত্যের অন্যতম সেরা কাব্যগ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত হয়।