ভূঁইয়া নজরুল »
ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেন গত শুক্রবার ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের সবচেয়ে দ্রুত গতির ট্রেন সুবর্ণ এক্সপ্রেসে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার পথে রওয়ানা হন। কিন্তু পথিমধ্যে কুমিল্লা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬ কিলোমিটার রেলপথ অতিক্রম করতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। ফলে চট্টগ্রাম থেকে সকাল ৭টায় ছেড়ে দুপুর ১২ টায় ঢাকার পৌঁছার কথা থাকলেও তা পৌঁছেছে এক ঘণ্টা ২৪ মিনিট বিলম্বে দুপুর ১টা ২৪ মিনিটে। কিন্তু এই ট্রেনটি যদি লাকসাম থেকে সোজা ঢাকা হয়ে যেতে পারতো তাহলে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় ঢাকা পৌঁছানো যেতো।
কুমিল্লা-আখাউড়া হয়ে ঢাকা পৌঁছাতে একজন ট্রেনযাত্রী প্রতিদিন তিন ঘণ্টা সময় অপচয় করছে। তাহলে একটি ট্রেনে যদি গড়ে ১৩টি কোচ থাকে, প্রতি কোচে যদি ৬০ জনের আসন থাকে, তাহলে মোট যাত্রী কমপক্ষে৭৮০ জন হওয়ার কথা । প্রতি জনের তিন ঘণ্টা করে সময়ের অপচয় হলে একটি ট্রেনের যাত্রীদের ২ হাজার ৩৪০ ঘণ্টা অর্থাৎ প্রায়প্রায় ৯৮ দিনসময় অপচয় হচ্ছে। একটি ট্রেনেরযাত্রীদের যদি ৯৮ দিন নষ্ট হয় তাহলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী ৫টি আন্ত:নগর ট্রেনের প্রতিটিতে৭৮০ জন করে গণনা করা হলে মোট যাত্রী হয় ৩ হাজার ৯০০। প্রতিজনের তিন ঘণ্টা সময় নষ্ট হলে মোট ১১ হাজার ৭০০ ঘণ্টা অর্থাৎ ৪৮৮ দিন সময় অপচয় হচ্ছে। সেই হিসেবে একদিনেই প্রায় দেড় বছর সময় নষ্ট হচ্ছে।
সময় বাঁচতে তাই ১৯৬৯ সালে ঢাকা-লাকসাম ৯০ কিলোমিটার কর্ডলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। আর এই কর্ডলাইন বাস্তবায়ন হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের দূরত্ব ৩২০ কিলোমিটার থেকে ১১০ কিলোমিটার কমে ২১০ কিলোমিটারে নেমে আসতো। তাহলে মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে রেলপথে যাতায়াত করা যেতো জানিয়ে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মঈনুল ইসলাম বলেন, ‘১৯৬৯ সালে যে প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা হয় পরবর্তীতে সরকারগুলো আর তা অনুভব করেনি। তারা উচ্চাবিলাসী বুলেট ট্রেন নির্মাণের জন্য দুই লাখ কোটি টাকার বাজেট করতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে অনেক কম খরচে ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইন নির্মাণ করা হলে অর্থনৈতিকভাবে তা অনেক বেশি লাভবানহতো। উপরন্তু বুলেট ট্রেনের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের নামে ১১০ কোটি টাকা গচ্চা গেছে।’
কর্ড লাইনে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে দূরত্ব ও সময় কমার কথা উল্লেখ করে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন,‘এতে চট্টগ্রামের সাথে ঢাকার যোগাযোগ অনেক সহজ ও দ্রুত হবে। বাঁচবে মানুষের শ্রমঘণ্টা।’
আবারো কর্ডলাইনে ঝুঁকছে রেলওয়ে
বুলেট ট্রেনের জন্য হাইস্পিড রেললাইন নির্মাণে হোঁচট খাওয়ার পর এখন আবারো কর্ডলাইনে ঝুঁকছেসরকার। কর্ডলাইন নির্মাণে সরকারের আগ্রহের কথা জানিয়ে রেলওয়ের পরিচালক (সংগ্রহ) আবিদুর রহমান বলেন, ‘কর্ডলাইন নির্মাণের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে আগ্রহ রয়েছে। এজন্য এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়ন করতে রাজি হয়েছে। সেজন্য সরকারও এগিয়ে এসেছে।’
তিনি আরো বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য যে অর্থ খরচ হবে তা দেবে এডিবি। এখন সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের কাজ চলছে। নিয়োগ হয়ে গেলে প্রতিষ্ঠানটি সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে কাজ করবে। আর এই কাজ করতে কমপক্ষে দুই বছর সময় লাগতে পারে।
এখানে কি ইলেকট্রিক ট্র্যাকশান রেললাইন নির্মাণ করা হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই রিপোর্ট পাওয়া ছাড়া এবিষয়ে কিছুই বলা যাবে না। তাই আগে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সার্ভে সম্পন্ন করতে হবে।
এদিকে সম্প্রতি রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন রেলপথ উন্নয়ন প্রসঙ্গে সংবাদ মাধ্যমকে বলেছেন, ঢাকা-লাকসাম কর্ডলাইনের বিকল্প নেই। এটি নির্মাণের লক্ষ্যে ২০০৬ সালের সমীক্ষার পর আবারো সমীক্ষা পরিচালনা করা হবে।
রেলপথমন্ত্রী সুজন আরও বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইস্পিড লাইন নির্মাণ প্রকল্পের সমীক্ষা শেষ হলেও সরকার এ মুহূর্তে হাইস্পিড লাইন নির্মাণের দিকে যাচ্ছে না। কারণ এতে ব্যয় অনেক বেশি। অর্থায়নেও অনিশ্চয়তা রয়েছে। কর্ডলাইন নির্মাণে অর্থের যোগান পাওয়া যাবে। সরকার এখন এদিকেই এগোচ্ছে। আরও অনেক আগেই কর্ডলাইন নির্মাণের প্রয়োজন ছিল বলে তিনি মন্তব্য করেন।
কর্ডলাইন নির্মাণে এগিয়ে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে সম্প্রতি মিডিয়াকে রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্র নাথ মজুমদার বলেন, ‘কর্ডলাইন নির্মাণের দিকেই আমরা যাচ্ছি। তার একমাত্র কারণ-ব্যয় কমিয়ে উন্নত সেবা দেওয়া সম্ভব। ভাড়া কমে আসলে সাধারণ যাত্রীরাও ভ্রমণে উৎসাহিত হবেন। তবে কিছু জরাজীর্ণ লাইন মেরামত, অবৈধ লেভেলক্রসিং বন্ধ করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন-কোচ পালটানোসহ বন্ধ স্টেশন চালু করতে হবে।’
কর্ডলাইন কী?
রেলওয়ে কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্বল্প দূরত্ব ও সোজা কোনো রেলপথ নির্মাণ করা হলে তাকে কর্ডলাইন বলা হয়। ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে লাকসাম পর্যন্ত যে ৯০ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হবে তা সোজা হবে। এজন্য এর নাম দেওয়া হয়েছিল কর্ডলাইন। তা নির্মাণ করা হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে চলাচলকারী ট্রেনগুলোকে টঙ্গী, নরসিংদী, ভৈরব, আশুগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাাড়ীয়া, আখাউড়া, কুমিল্লা,লাকসাম আসতে হবে না। তখন ঢাকা থেকে সোজা নারায়ণগঞ্জ হয়ে রেলপথ লাকসামে চলে আসতে পারবে।
কর্ডলাইনের ইতিবৃত্ত
উদ্যোগের ৫৩ বছর পর আবারো পুরানো বৃত্তে ফিরছে সরকার। অর্থাৎ ঢাকা-লাকসাম কর্ড লাইন নির্মাণে উদ্যোগী হচ্ছে। ১৯৬৯ সালে কর্ডলাইন নিয়ে সমীক্ষায় তিনটি বড় ও মাঝারি সেতুসহ ২৬ কোটি টাকা নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছিল। পরবর্তীতে ১৯৭৬-৭৬ সালে আবারো এর নির্মাণ নিয়ে অগ্রগতি হলে তখন বাজেট ৬৩ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। ১৯৯৮-৯৯ সালে রেল পুনঃগঠন সংস্কার প্রণয়নে গঠিত কমিটি এই কর্ডলাইন নির্মাণে আবারো সুপারিশ করে এবং তখন খরচ ধরা হয় ৯০০ কোটি টাকা। ২০০৬ সালে ফের সমীক্ষা চালানো হয় এবং এই সমীক্ষার রিপোর্ট দেওয়া হয় ২০০৮ সালে। সেই রিপোর্টে এর বাজেট ধরা হয় ২৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
উল্লেখ্য, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন হলো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রেলপথ। এই পথে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে যোগাযোগ রয়েছে রেলওয়ের। আগামীতে মাতারবাড়িতে বন্দর হচ্ছে। সেই বন্দরের সাথেও রেললাইন যুক্ত করা হচ্ছে। ফলে আগামীর যাতায়াত ব্যবস্থায় রেলপথ আরো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।