আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) চলতি বছরে অর্থাৎ ২০২০ সালে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জন করা শীর্ষ ৩টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে মর্মে উল্লেখ করেছে। গত মঙ্গলবার প্রকাশিত আইএমএফএর ওয়ার্লেড ইকোনমিক আউটলুকে পূর্বাভাস দেওয়া হয় যে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি হবে ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। শীর্ষ তিন এর অন্য দুটি দেশ হলো গায়ানা ও দক্ষিণ সুদান।
আইএমএফ এর প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরে বিশ্বের ২২টি দেশের প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক হবে। যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জার্মানি, যুক্তরাজ্যসহ বড় অর্থনীতির দেশগুলির প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হবে বলে মনে করছে এই বহুজাতিক দাতা সংস্থা। আইএমএফএর প্রতিবেদনে ২০২২ সালে বাংলাদেশের জিডিপি বেড়ে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ এবং ২০২৩ সালে তা ৭ দশমিক ৩ শতাংশে উন্নীত হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। ফলে করোনার আগের অবস্থায় ফিরে যেতে আরও বছর দুয়েক সময় লাগবে। করোনা পরিস্থিতিতে লকডাউন ৩ মাসেরও অধিক সময় থাকায় আমাদের অর্থনীতি বেশ নাজুক অবস্থায় ছিলো। জুনÑজুলাই থেকে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। ২০১৯Ñ২০২০ সালে সরকারিভাবে জিডিপি ৫ দশমিক ২ শতাংশ অর্জিত হয়েছে বলা হয়। আইএমএফ সহ অন্যান্য দাতা সংস্থা প্রবৃদ্ধির যে পূর্বাভাস দিচ্ছে তাতে অর্থনীতি ইতিবাচক ধারায় আছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। প্রবৃদ্ধি নিয়ে নানা মহলে বিতর্ক থাকলেও এটি বলা যায় যে, রপ্তানি ও প্রবাসী আয়, কৃষি উৎপাদন ভাল হওয়ায় বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে রয়েছে তবে কর্মসংস্থান এবার করোনার অভিঘাতে বেশ ধাক্কা খেয়েছে। এই খাত সংকুচিত হয়েছে। অবকাঠামো নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্প ও এসএমই খাত জোরদার হলে এ ক্ষেত্রে উন্নতি হবে।
তবে আশঙ্কার দিকও আছে। ইউরোপে এখন করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলছে। বিশ্বব্যাপী মন্দা চলছে, ‘এই পরিস্থিতিতে ইউরোপÑআমেরিকার চেইন শপগুলি বন্ধ বা সংকুচিত হতে পারে। এর ফলে আমাদের পোশাক রপ্তানি কমে যেতে পারে। অর্থনৈতিক মন্দার কারণে প্রবাসী আয়ে প্রভাব পড়তে পারে। প্রবাসীদের কর্মসংস্থানও সংকুচিত হতে পারে। আইএমএফ এর আর একটি রিপোর্টে বলা হয়, চলতি বছর মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ১০ দশমিক ৫ শতাংশ কমে ১ হাজার ৮৭৭ ডলারে এসেছে। আর বাংলাদেশের জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৮৮৮ ডলারে। একটি দেশের সমৃদ্ধি বিশ্লেষণে অর্থনীতিবিদরা জিডিপির পাশাপাশি মাথাপিছু আয়ের প্রবৃদ্ধি ব্যবহার করেন। অবশ্য করোনার কারণে ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০২১ সালে সেটি নাও থাকতে পারেÑএমন আভাসও দিয়েছে আইএমএফ। বাংলাদেশের এই প্রবৃদ্ধি বিশ্লেষণে অর্থনীতির সামগ্রিক গতিচিত্র সঠিকভাবে পাওয়া যাবে না। আমাদের মাথাপিছু জিডিপি বাড়লেও আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য প্রকট। মাথাপিছু গড় আয় বাড়ল কিন্তু পিছিয়ে পড়া কিংবা সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর আয় কিংবা সম্পদ বাড়ল না, সেটি উন্নয়নের প্রকৃত চিত্র হতে পারে না। এরূপ ও দেখা গেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা, আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিচ্ছে। এতে আমাদের দেশের রাজনৈতিক এবং বিশেষজ্ঞ মহলও বিভ্রান্ত হয়ে নানা মতামত দিচ্ছেন।
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূলে যে ৩টি উপাদান অনুঘটকের কাজ করছে সেখানে আমাদের নি¤œআয়ের পরিশ্রমী জনগোষ্ঠীর অবদানই বেশি। আমাদের দায়িত্ব হবে এই ৩টি ক্ষেত্র যথাÑরপ্তানিÑযার মধ্যে পোশাক রপ্তানিই প্রধানÑপ্রবাসী আয়, কৃষি উৎপাদন খাতে বর্তমান অর্জনে এগিয়ে নেওয়া। করোনার যে দ্বিতীয় ঢেউ আশঙ্কা করা হচ্ছে তা মোকাবেলায় জীবন ও জীবিকা একসঙ্গে মেলাতে হবে। জীবনযাপনে স্বাস্থ্যবিধির কঠোর অনুসরণ, শিল্পক্ষেত্রে করোনা মোকাবেলায় যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নেওয়া এবং শ্রমজীবী মানুষের জীবনমান, পুষ্টি ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দিকে দৃষ্টি দেওয়া হবে আমাদের সম্মিলিত দায়িত্বের অংশ।
মতামত সম্পাদকীয়