চট্টগ্রাম বন্দর
তিনটি টার্মিনালের একটি নির্মাণ করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ
ভূঁইয়া নজরুল <
প্রায় এক দশক ধরে শোনা যাচ্ছে বে টার্মিনালের গল্প। কিন্তু কবে নাগাদ এর কার্যক্রম শুরু হবে তা নিয়ে সময়ে সময়ে শুধু আশ্বাসই পাওয়া গেছে। তবে এবার একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়া গেল। বে টার্মিনালের তিনটি টার্মিনালের মধ্যে একটি টার্মিনাল নির্মাণ করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ হতে যাওয়া এই টার্মিনালের কাজ শিগগিরই শুরু হবে। আর তা ২০২৪ সালের মধ্যেই শেষ করা যাবে বলে আশাবাদী চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান।
হালিশহর সাগরপারের ভূমিতে ইতিমধ্যে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। এই স্থানেই ২০২৪ সালের মধ্যে বে টার্মিনালের তিনটি টার্মিনালের মধ্যে একটি টার্মিনাল নির্মাণের কাজ শেষ করা যাবে বলে বলে জানান বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান। তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসের সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয় একটি টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন করবে। বাকি দুটি টার্মিনাল পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) জি টু জি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন হবে।’
একটি টার্মিনাল নির্মাণ করতে গেলে ব্রেক ওয়াটার (সাগর থেকে আসা ঢেউ নিয়ন্ত্রণ) কে নির্মাণ করবে- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্রেক ওয়াটার এবং বন্দরের জাহাজ যাতায়াতের চ্যানেল তৈরিতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন করার কথা।
তিনটি টার্মিনালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কোন প্রান্তের টার্মিনালটি করবে জানতে চাইলে এম শাহজাহান বলেন, আমরা দক্ষিণ প্রান্তের প্রথম টার্মিনালটি নেবো এবং পর্যায়ক্রমে উত্তরপ্রান্তের টার্মিনালগুলো পিপিপি পদ্ধতিতে যে প্রতিষ্ঠান বরাদ্দ পাবে তাদের দেওয়া হবে।
বর্তমানে মাটি ভরাটের কাজ চলতে থাকা বে টার্মিনাল ২০২৪ সালের মধ্যে শেষ করা যাবে কিনা জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার আরিফুর রহমান বলেন, ‘সাগরের ভেতর থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে মাটি ভরাট করে জাহাজ চলাচলের উপযোগী করার বিষয়ে ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক সম্মতি দিয়েছে। যেহেতু একটি অংশে মাটি ভরাট কাজ প্রায় শেষ তাই নির্ধারিত সময়ে টার্মিনাল নির্মাণে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’
জানা যায়, তিনটি টার্মিনালের সবকটি টার্মিনালের আয়তন সমান হবে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ যে টার্মিনালটি নির্মাণ করবে সেখানে চারটি জেটি থাকবে। বাকি দুটি টার্মিনাল পিপিপি মডেলে পিএস সিংগাপুর এবং ইউএই এর ডিপি ওয়ার্ল্ড এর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হতে পারে। এলক্ষ্যে এই দুই প্রতিষ্ঠান থেকে পৃথকভাবে টেকনিক্যাল ও ফিনান্সিয়াল বিস্তারিত প্রস্তাব দাখিলের জন্যও বলা হয়েছে।
বে টার্মিনাল নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সভা সেমিনারে বক্তব্য দিয়ে আসছেন চিটাগাং চেম্বারের প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ‘একটি টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়ন হবে বলে তা দ্রুত হবে। এতে দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের দ্রুত প্রসার ঘটবে। বে টার্মিনাল দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
গত কয়েক বছর ধরে বে টার্মিনালের তিনটি টার্মিনালই পিপিপি পদ্ধতিতে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়ে আসছিল। সম্প্রতি বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এবিষয়ে প্রস্তাবনা দেয়ার পর একটি টার্মিনাল বন্দরের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মাণ করার বিষয়ে সম্মত হয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। টার্মিনাল পরিচালনায় দেশে সবচেয়ে অভিজ্ঞ সাইফ পাওয়ার টেক। এবিষয়ে সাইফ পাওয়ার টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুহুল আমিন তরফদার বলেন, ‘বে টার্মিনাল নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনটি টার্মিনাল পিপিপি পদ্ধতিতে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে দিলে দেশের হাতে কিছু থাকতো না। এখন একটি টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ পরিচালনা করবে বলে বন্দরের সক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের রাজস্বও বাড়বে। একইসাথে বন্দর পরিচালনায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও এগিয়ে যাবে।’
এদিকে বে টার্মিনাল নিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা কী জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান বলেন, ‘পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টের ভিত্তিতে টার্মিনাল নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ।’
অপর এক সূত্রে জানা যায়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান দিয়ে সার্ভের কাজটি তৈরি করবে পিপিপি কর্তৃপক্ষ। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে দরপত্র আহবান করবে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের আগস্টে বে টার্মিনালের ৬৮ একর ভূমি বরাদ্দ পায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। আরো ৮৭০ একর ভূমি বরাদ্দের প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ইপিজেড থেকে দক্ষিণ কাট্টলী রাসমনিঘাট পর্যন্ত সাড়ে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ এলাকায় সাগরের ভেতরের প্রায় ২৩০০ একর জায়গায় নির্মিত হবে এই বে টার্মিনাল। জোয়ার-ভাটা, দিন-রাত, বাঁকা চ্যানেল কিংবা ড্রাফটের বিবেচনায় কর্ণফুলী নদীর জেটিতে জাহাজ ভিড়লেও বে-টার্মিনালের ক্ষেত্রে সেই সীমাবদ্ধতা নেই। বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর জেটিতে পৌঁছাতে একটি জাহাজকে ১৫ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করতে হয়। কিন্তু বে টার্মিনাল নির্মাণ করা হলে তা শূন্য কিলোমিটারের মধ্যেই বার্থিং করতে পারবে। বে টার্মিনাল নির্মাণ হলে যেকোনো দৈর্ঘ্য ও প্রায় ১২ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারবে। এখানে ২৪ ঘণ্টা জাহাজ পরিচালনা করা যাবে। বিদ্যমান পোর্ট জেটিতে একসাথে ১৬টি জাহাজ বার্থিং করা গেলেও বে টার্মিনালে গড়ে প্রায় ৫০টি জাহাজ একইসাথে বার্থিং করা যাবে। এজন্য এই টার্মিনালকে আগামীর বন্দর বলা হয়ে থাকে।
ক্যাপশন : বে টার্মিনালে চলছে মাটি ভরাটের কাজ। ছবি- রনি দে