চট্টগ্রামে করোনা
ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ বাড়ছে
সংক্রমণ জুলাই পর্যন্ত কমবেশি থাকবে
হাসপাতালে রোগীর চাপ
মোহাম্মদ কাইয়ুম »
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা রেড জোনে একমাসে আগেও যেখানে দৈনিক ৬ থেকে ৮ জন নতুন রোগী হতো, বর্তমানে সে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১২ থেকে ১৬ জনে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া মে মাসের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা যেখানে ১০০ থেকে ১৫০ জনের আশাপাশে ছিল। বর্তমানে সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫০ জনে। করোনার নতুন রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ার চিত্র শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের না। এ চিত্র চট্টগ্রামের বেশিরভাগ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে।
চট্টগ্রামে চলতি বছরের মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে সংক্রমণের হার কিছুটা কমে আসলেও বিগত ১০ দিনে সারাদেশের মতো বাড়ছে সংক্রমণের হার। তবে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন উপজেলাগুলোর তুলনায় নগরীতে সংক্রমণের হার বেশি থাকলেও বর্তমানে সে চিত্র ভিন্ন। বর্তমানে নগরীর পাশাপাশি উপজেলাগুলোতে সমানহারে বাড়ছে করোনায় শনাক্তের সংখ্যা। গত কয়েক দিনে সে সংখ্যা নগরীকে ছাড়িয়ে গেছে। এরইমধ্যে গতকাল বৃহস্পতিবার ২৪৭ জনের শনাক্তের মধ্যে নগরীর ১২৩ জনের বিপরীতে উপজেলাগুলোতে শনাক্ত ছিল ১২৪ জন। উপজেলা পর্যায়ে সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের করোনার পরিস্থিতি দিনদিন অবনতির দিকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীনতা এবং করোনার ভারতীয় ধরনে নগরীর পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে সংক্রমণ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত ১০ দিনে চট্টগ্রাম নগরীর পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়েও উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে শনাক্তের সংখ্যা। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চলাকালীন ৩ এপ্রিল নগরীর ৮২ শতাংশ সংক্রমণের হারের বিপরীতে যেখানে উপজেলা পর্যায়ে সংক্রমণ হার ছিল মাত্র ১৮ শতাংশ। সেখানে বৃহস্পতিবার নগরীর ৪৯ শতাংশ সংক্রমণের বিপরীতে উপজেলা পর্যায়ে সংক্রমণের হার ছিল ৫১ শতাংশ। এছাড়া গত ১০ দিনে উপজেলা পর্যায়ে সংক্রমণের সে চিত্র ৪০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত উঠানামা করছে। গত ১০ দিনে নগরীর তুলনায় উপজেলা পর্যায়ে সংক্রমণ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে চট্টগ্রামের দৈনিক সংক্রমণের হার। চলতি মাসের শুরুতে দৈনিক সংক্রমণের হার যেখানে ৯ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠানামা করতো সেখানে গত ৩ দিনে সে হার ২১ থেকে ২৩ শতাংশে উঠানামা করছে। এছাড়া গত দুই মাসে চট্টগ্রামে দৈনিক সর্বোচ্চ শনাক্তের সংখ্যা ছিল ১৯১। সেখানে বৃহস্পতিবার শনাক্তের সংখ্যা ছিল ২৪৭ জন। দৈনিক শনাক্তের পাশাপাশি বেড়েছে হাসপাতালে রোগীর চাপ। দুই মাস আগে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেড জোনে দৈনিক রোগী ভর্তির সংখ্যা ছিল ৬ থেকে ৮ জন। বৃহস্পতিবার সে সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ জনে। এ চিত্র চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ চট্টগ্রামের অন্যান্য হাসপাতালের।
করোনার ভারতীয় ধরন চট্টগ্রামে সংক্রমণ হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ মনে করছেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আব্দুর রব মাসুম। তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টটা (ভারতীয় ধরন) চলে এসেছে, সেকারণে চট্টগ্রামে করোনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমি গত কয়েক দিনে যতগুলো রোগী দেখেছি বেশিরভাগই রোগীর মধ্যে ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের লক্ষণ দেখেছি। এরমধ্যে সীমান্তবর্তী জেলা নওগা থেকে আসা করোনা রোগীও ছিল। এদের মাধ্যমে চট্টগ্রামে করোনার ভারতীয় ধরন ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি।’
করোনার ভারতীয় ধরন দ্রুত ছড়ায় জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমণ খুবই দ্রুত ছড়ায়। সেকারণে রোগীর অবস্থা দ্রুতই খারাপের দিকে চলে যায়। তাই সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই বাড়ছে।’
স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাসীনতাই চট্টগ্রামে সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণ মনে করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের উদ্যোক্তা ডা. বিদ্যুৎ বড়ুয়া। তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আমাদের মানুষেরা হচ্ছে যত কম সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার দেখে তারা ততবেশি অবহেলা করে উদাসীন হয়েছে। ততবেশি জড়ো করে অনুষ্ঠান করেছে যার কারণে করোনার ঊর্ধ্বগতি। পাশাপাশি অনেকে করোনাকে অন্য সাধারণ রোগের মতো মনে করার পাশাপাশি করোনা উপস্থিতি স্বীকার না করে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলছে না। এছাড়াও মানুষ স্বাভাবিক জীবন-যাপনে চলে যাওয়ায় সংক্রমণের হারটা ঊর্ধ্বমুখী। যার প্রমাণ মেলে নগরীর পাশাপাশি উপজেলা পর্যায়ে সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায়। আগে গ্রামের মানুষের ধারণা ছিল তাদের করোনা হবে না। কিন্তু বর্তমানে করোনার মিউটেশন হতে হতে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম তাদের আক্রান্ত করছে। ’
সারাদেশের মতো চট্টগ্রামে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি জানিয়ে চট্টগ্রাম সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘বর্তমানে সারাদেশের মতো চট্টগ্রামেও আক্রান্তের সংখ্যা বেশি। আমাদের ধারণা এ সংক্রমণ জুলাই পর্যন্ত কমবেশি থাকবে। সে হিসেবে লকডাউনসহ আমাদের সবধরনের প্রস্তুতি মঙ্গলবারের জেলা প্রশাসনের সাথে মিটিংয়ে নেওয়া হয়েছে। সে সাথে গত বুধবার রাত ৮টা থেকে নগরীর সবকিছুই বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এ বিষয়গুলো তদারকি করবেন। যতভালোভাবেই এসব নির্দেশনা মানা হবে ততই সংক্রমণ কমতে পারে। বর্তমানে জেলা কমিটির মাধ্যমে ফটিকছড়ি উপজেলা লকডাউনের আওতায় আনা হয়েছে। পরবর্তীতে যেসব উপজেলায় সংক্রমণ বাড়তে থাকবে সেক্ষেত্রে সেসব উপজেলায় জেলা কমিটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’
জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বাধ্য করতে হবে জানিয়ে সিভিল সার্জন আরো বলেন, ‘কোন মানুষ জানে না মাস্ক পড়তে হবে? কোন মানুষ জানে না সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে? এখন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে মানুষকে বাধ্য করতে হবে। মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে জ্ঞান থাকলেও বর্তমানে অভ্যাস বা চর্চা নেই। সেকারণে জেল জরিমানার মাধ্যমে মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য বাধ্য করতে হবে।’