হেমন্ত নবান্নের সোনা রোদ আর শীতের আগমনী সংকেত

জনি সিদ্দিক »

ষড়ঋতুর বাংলাদেশে শরৎ তার শুভ্রতা আর কাশফুলের ভেলা ভাসিয়ে বিদায় নেওয়ার পরেই আগমন ঘটে এক শান্ত, স্নিগ্ধ ঋতুর। যার নাম হেমন্ত। বাংলা পঞ্জিকায় কার্তিক ও অগ্রহায়ণ; এই দুই মাস নিয়েই হেমন্তকাল। এই ঋতুকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। গ্রীষ্মের প্রখরতা বা বর্ষার অঝোর ধারার মতো এর কোনো উদ্দামতা নেই, আছে এক নীরব, কুয়াশাচ্ছন্ন মাধুর্য। এটি প্রকৃতিতে শীত-শরতের এক স্নিগ্ধ মাখামাখি, যা একদিকে ফসল তোলার তৃপ্তি এনে দেয়, অন্যদিকে আসন্ন শীতের হিমেল স্পর্শে মনকে করে তোলে রোমান্টিক।
কবি জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হেমন্ত পেয়েছে শৈল্পিক রূপ। ‘পেঁচা’ কবিতায় হেমন্তের অঙ্গনে দাঁড়িয়ে দুরন্ত শীতকে অভ্যর্থনা জানানো কুয়াশা ও শিশিরের দারুণ এক ছবি এঁকেছিলেন জীবনানন্দ দাশ।
সেখানে তিনি লেখেন,
‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে/হেমন্তের মাঠে-মাঠে ঝরে/শুধু শিশিরের জল/অঘ্রাণের নদীটির শ্বাসে/হিম হয়ে আসে/বাঁশপাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা/বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা/ধানখেতে-মাঠে/জমিছে ধোঁয়াটে/ধারালো কুয়াশা;’
হেমন্তের প্রকৃতিতে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে আকাশ আর মাঠে।
হেমন্ত মানেই পাকা ধানের ঋতু। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে তখন কেবল সোনালি রঙের ছড়াছড়ি। আমন ধান অগ্রহায়ণ মাসে এসে পরিপক্ক হয়। মাঠের দিকে তাকালে মনে হয়, যেন প্রকৃতি তার বিশাল বক্ষে এক সোনা রঙের চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। এই সোনা রঙের রূপ দেখে কৃষকের চোখে নেমে আসে তৃপ্তির হাসি। এই অপরূপ দৃশ্যই হেমন্তের প্রধান বৈশিষ্ট্য।
দিনের বেলা মিষ্টি সোনা-রোদ থাকলেও, ভোরের প্রকৃতিতে হালকা শীতের ছোঁয়া লাগে। এ সময় সকালের ঘাস, শস্যক্ষেত বা ধান গাছের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশির জমতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়: ‘একটি ধানের শীষের উপরে/একটি শিশির বিন্দু।’ এই শিশির কণাগুলো মুক্তো দানার মতো ঝলমল করে জানান দেয় যে, শীত আর বেশি দূরে নয়। শরতের পেঁজা তুলোর মতো মেঘ তখন ধীরে ধীরে বিদায় নেয়, ফলে হেমন্তের আকাশ থাকে সম্পূর্ণ নির্মল, ঝকঝকে নীল।
তবে এতকিছুর মধ্যে ফলের দিক দিয়ে হেমন্তকে কিছুটা কৃপণ বলা যায়, তবুও এই ঋতুতে কিছু মনোমুগ্ধকর ফুল ফোটে, যা তার স্নিগ্ধতাকে বাড়িয়ে তোলে। এই সময় ফোটে শিউলি, কামিনী, গন্ধরাজ, দেবকাঞ্চন, মল্লিকা, ছাতিমফুল। রাতের বেলা ফোটা শিউলির সুবাসে ভোরবেলা চারপাশ এক মিষ্টি সুগন্ধে ভরে ওঠে, যা হেমন্তের আগমনী বার্তা বহন করে।
কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে হেমন্তকাল মানেই ফসলের প্রাচুর্য এবং এক সর্বজনীন লৌকিক উৎসব-”নবান্ন।” দুটি শব্দের সমন্বয়ে যথাক্রমে- ‘অগ্র’ (ধান) এবং ‘হায়ণ’ (কাটার মওসুম) থেকে এসেছে অগ্রহায়ণ মাসের নামকরণ। এই মাসে ধান কাটা ও ঘরে তোলাকে কেন্দ্র করেই পালিত হয় নবান্ন উৎসব।
ধান কাটা শুরু হলে গ্রামীণ জনপদে উৎসবের আমেজ শুরু হয়। কৃষকেরা দলবেঁধে মাঠে যান ফসল কাটতে। কাঁধে ধানের আঁটি বোঝাই করে মেঠোপথ ধরে বাড়ি ফেরার দৃশ্য যেন এক জীবন্ত ছবি। এই ফসলই কয়েক মাসের খাদ্য ও জীবনধারণের ভিত্তি। নতুন ধান ঘরে তোলার পর কৃষকের বাড়িতে শুরু হয় মাড়াই ও ধান শুকানোর ব্যস্ততা। গৃহস্থরা রাত জেগে ধান সেদ্ধ করে এবং সকালে উঠানে সেই ধান শুকানোর কাজে হাত দেন।
সেই ধান শুকানোর পরে নবান্ন উৎসবের মূল আকর্ষণ শুরু হয়। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি নানা রকম পিঠাপুলি, ফিরনি ও পায়েস। নতুন চালের গুঁড়ো ও খেজুর বা আখের গুড় বা চিনি দিয়ে তৈরি এসব সুস্বাদু খাবার আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীর বাড়িতে বিতরণ করা হয়। এই উৎসব ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল গ্রামবাসীর মধ্যে এক স্বতঃস্ফূর্ত মিলন ও অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করে। কোথাও কোথাও এ উপলক্ষে বাউল গান, যাত্রা ও লাঠি খেলার আয়োজন করা হয়।
হেমন্তের শান্ত আবহাওয়া মানুষের মন ও মেজাজেও পরিবর্তন আনে। নাতিশীতোষ্ণ পরিবেশ কাজের জন্য খুব আরামদায়ক। বর্ষার কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা বা গ্রীষ্মের দাবদাহ না থাকায় এই সময় মানুষ অনেকটা স্বস্তিতে থাকে।
হেমন্তের শেষের দিকে, বিশেষ করে কার্তিক মাস শেষ হলেই প্রকৃতিতে শীতের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। খাল-বিল বা নদ-নদীর পানি কমতে শুরু করে। গাছিরা খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুতি নেন। বাজারে পাওয়া যায় শীতের আগমনী সবজি। অনেকে শীত থেকে বাঁচার জন্য লেপ-কম্বল ঝেড়ে রোদে দেওয়ার কাজ শুরু করে দেন। এই ধীরে ধীরে পরিবর্তনই হেমন্তের সৌন্দর্য।
হেমন্তকাল বাংলার ঋতুচক্রের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণ। এটি একদিকে যেমন বর্ষার সমাপ্তি টেনে দেয়, তেমনি অন্যদিকে শীতকে স্বাগত জানায়। এটি তিক্ততার ঋতু নয়, বরং এটি প্রাচুর্য ও প্রাপ্তির ঋতু। সোনালি ধান, শিশির ভেজা ঘাস, নির্মল আকাশ আর নবান্নের আনন্দ, সব মিলিয়ে হেমন্ত আমাদের জীবনে এক গভীর শান্তি আর স্নিগ্ধতা নিয়ে আসে। এই ঋতুর মৃদু হিমেল বাতাস ও মিষ্টি রোদ বাঙালি মনকে এক বিশেষ ভাবাচ্ছন্ন করে তোলে। হেমন্তকে তাই শীতের আগমনী সুর আর প্রকৃতির সবচেয়ে নীরব; কিন্তু কল্যাণময়ী রূপ হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।