চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ড : এইচএসসি ফলাফল
ভূঁইয়া নজরুল »
হিমেল বড়ুয়া। চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল। এবারের প্রকাশিত ফলাফলে সব বিষয়ে জিপিএ-৫ থাকলেও পদার্থ বিজ্ঞানের ব্যবহারিক পরীক্ষায় তাকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। ফলে পদার্থ বিজ্ঞানে তাকে অকৃতকার্য দেখানো হয়। বিষয়টি জানতে পেরে ওই শিক্ষার্থীর পিতা নন্দন বড়ুয়া ফলাফল প্রকাশের দিন দুপুর তিনটার দিকে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে আসেন। এসে জানতে পারেন পদার্থ বিজ্ঞানের ব্যবহারিকে তার ছেলেকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। আর হিমেল বড়ুয়ার এ সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই ফলাফল প্রকাশের দিন বিকেলে কিছু সময়ের জন্য ফলাফলে অসঙ্গতি দেখা দিয়েছিল।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বলেন, ‘এই ছাত্রের ফলাফলে (ঢ) কেন এসেছে তা শনাক্ত করতে গিয়ে বিকেলের দিকে ফলাফলে ভুল হয়েছিল ক্ষণিক সময়ের জন্য। পরবর্তীতে তা সংশোধন করা হয়।’
কি হয়েছিল সেদিন?
কথা হয় হিমেল বড়ুয়ার বাবা নন্দন বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার ছেলে পরীক্ষায় খারাপ করতে পারে না। কেন খারাপ করেছে তা জানতে বোর্ডে গিয়েছিলাম ফলাফল প্রকাশের দিন (১৩ ফেব্রুয়ারি) দুপুর তিনটার দিকে।
পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের সাথে দেখা করার পর তিনি কম্পিউটার চেক করে বলেন, আপনার ছেলের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগে ব্যবহারিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত এসেছে। পরবর্তীতে পদার্থ বিজ্ঞানের ব্যবহারিকের নম্বর চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ (পরীক্ষা কেন্দ্র) থেকে নিয়ে বোর্ডে জমা দিয়ে আসি। বোর্ড কর্তৃপক্ষ বলেছে ফলাফল ঠিক করে দেবে। কিন্তু এখনও ঠিক করেনি।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বোর্ডের কম্পিউটার শাখার প্রধান কিবরিয়া মাসুদ খান বলেন, ‘উল্লেখিত শিক্ষার্থীর ফলাফলে (ঢ) দেখাচ্ছিল। আমরা তার পুরো ফলাফল যাচাই করে দেখতে পাই পদার্থ বিজ্ঞানের ব্যবহারিক নম্বর ছাড়া উভয় পত্রে ১৪৩ নম্বর পেয়েছে। কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞান ব্যবহারিকে অনুপস্থিত দেখানো হয়েছে। কিন্তু টেবুলেশন নীতিমালা অনুযায়ী কেউ কোনো বিষয়ে আংশিক অনুপস্থিত থাকলে তা (অঅঅ) প্রদর্শিত হবে। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের উপস্থিতিতে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। পরবর্তীতে আমরা তা সংশোধন করি। কিন্তু সংশোধন করতে গিয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের নম্বর উচ্চতর গণিতের সাথে অদল বদল হয়ে যায়। অদল বদল হয়ে যাওয়া ঠিক করতে বিকাল চারটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত এ সময় ওয়েবসাইটে ভুল ফলাফল প্রদর্শন করে। তবে এতে জিপিএ’র কোনো পরিবর্তন হয়নি।
কিবরিয়া মাসুদ খান আরো বলেন, বোর্ডের সকল তথ্য টেলিটকের কাছে সংরক্ষিত থাকে। সেখানকার ফলাফলে কোনো পরিবর্তন হয়নি। এমনকি বোর্ডের বর্তমান ফলাফলেও কোনো পরিবর্তন নেই। বোর্ডের ফলাফল নম্বর দেখা যায় মাত্র এক সপ্তাহের জন্য। পরবর্তীতে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায়।
কিন্তু ব্যবহারিকে কেন সমস্যা হয়েছে জানতে চাইলে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ বলেন, এবারের পরীক্ষা পরিচালনা বিধিমালা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নোট খাতার বিপরীতে বিষয় শিক্ষকগণ কেন্দ্র সচিবের কাছে ব্যবহারিকের নম্বর পাঠিয়ে দেবেন। কেন্দ্র সচিব সেই নম্বর অনলাইনে ইনপুট দেবেন। কিন্তু অনেকে এই নম্বর না দেওয়ায় ফলাফলে অনুপস্থিত দেখিয়েছে।
অসঙ্গতি নিয়ে তদন্ত কমিটির শোকজে বোর্ডে তোলপাড়
এদিকে ফলাফলে ভুল হলে তা শনাক্ত করার জন্য একটি প্রক্রিয়া রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় অবশ্যই শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান অবগত থাকতে হবে। কিন্তু শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানকে অবগত না করে ফলাফলের এই পরিবর্তন করায় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। তিন সদস্যের সেই তদন্ত কমিটি কাজও করছে। একইসাথে দায়িত্বে অবহেলার জন্য পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছে একটি ব্যাখ্যাও চেয়েছিলেন শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আলীম। কিন্তু ব্যাখ্যায় সন্তোষজনক না হয়ে কেন তা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করা হবে না সেই মর্মে কারণ দর্শানোর একটি চিঠি গতকাল মঙ্গলবার দেয়া হয়েছে বলে জানান প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আলীম। তবে চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেননি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ।
তবে তদন্তে নতুন মাত্রা যোগ করেছে তদন্ত কমিটি পেনড্রাইভের মাধ্যমে ফলাফল কম্পিউটার শাখা থেকে নিয়ে যাওয়া। এবিষয়ে শিক্ষাবোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নারায়ন চন্দ্র নাথ লিখিতভাবে চেয়ারম্যান বরাবর জানিয়েছেন, বোর্ডের গোপন নথি আমার (পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক) অনুমোদন ছাড়া কম্পিউটার শাখা থেকে নিয়ে গেছেন। তা বোর্ড আইনের পরিপন্থি।
পরীক্ষার ফলাফল তৈরি সংক্রান্ত কিছু ডকুমেন্ট নেওয়ার জন্য তদন্ত কমিটি আবেদন করেছিল। আবেদনের প্রেক্ষিতে চেয়ারম্যান সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে বলেছিল। কিন্তু আবেদনের কোথাও উল্লেখ নেই গোপন নথি কিংবা কোনো তথ্য পেনড্রাইভ দিয়ে নেওয়ার বিষয়ে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ আবদুল আলীম বলেন,‘ যেহেতু তদন্ত কমিটি গোপন বিষয় নিয়ে কাজ করছে তাই তাদের সাপোর্ট দিতে হবে। আর সাপোর্ট না দিলে কাজ করবে কিভাবে। কিন্তু তারা যে পেনড্রাইভ দিয়ে ফলাফল নিয়ে যাবে তা কোথাও বলা ছিল না। আর কম্পিউটার শাখা থেকে তা নেওয়ার সময় বলা হয়নি কেন?
এদিকে পেনড্রাইভ দিয়ে ফলাফল নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কথা হয় গঠিত তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান প্রফেসর মোজাম্মেল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমরা পেনড্রাইভ দিয়ে কোনো ফলাফল আনিনি। তদন্তের কাজে যা যা প্রয়োজন হয় সেগুলোর সহায়তা নিচ্ছি বোর্ডের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে।’
উল্লেখ্য, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামসহ সারাদেশে এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়। সেই ফলাফল প্রকাশের দিন বিকেলে ওয়েবসাইটে অসঙ্গতি চোখে পড়ে। ১২০ নম্বরের পরীক্ষায় ১২৮ নম্বর পেয়েছে অনেকে। এই ঘটনায় বোর্ডের পক্ষ থেকে তদন্ত কার্যক্রম চলছে।