সুপ্রভাত ডেস্ক »
গণআন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেছেন, জুলাই-অগাস্টের আন্দোলনের প্রতিটি হত্যার বিচার করা হবে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, “প্রতিটি হত্যার বিচার আমরা করবই। জুলাই-অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচারের যে উদ্যোগ আমরা নিয়েছি, তার কাজও বেশ ভালোভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকেও আমরা ভারত থেকে ফেরত চাইব।”
রোববার সন্ধ্যা ৭টায় তার এই ভাষণ রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যমে একযোগে প্রচার করা হয়।
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনের মুখে গত ৫ অগাস্ট দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা। তখন থেকে তিনি ভারতে অবস্থান করছেন।
দেশ ছাড়ার পর আওয়ামী লীগ প্রধানের বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা হয়েছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক অপরাধ টাইব্যুনালেও তার বিরুদ্ধে কয়েকটি অভিযোগও জমা পড়েছে। এর মধ্যে ‘গণহত্যার’ দুটি অভিযোগে হাসিনাসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে।
আগামী ১৮ নভেম্বরের মধ্যে হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও অন্য আসামিদের আদালতে হাজির করার নির্দেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল।
বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করা হবে বলে পরোয়ানা জারির পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেছেন।
জাতির উদ্দেশে তার চতুর্থ ভাষণে গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংঘটিত সব অপকর্মের বিচার করার কথাও বলেন ইউনূস।
তিনি বলেন, “কেবল জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডই নয়, আমরা গত ১৫ বছরে সব অপকর্মের বিচার করব। অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছে, খুন হয়েছে এই সময়ে। আমরা গুমের তদন্তে একটি কমিশন গঠন করেছি। কমিশন প্রধান আমাকে জানিয়েছেন, অক্টোবর পর্যন্ত তারা ১,৬০০ গুমের তথ্য পেয়েছেন। তাদের ধারণা এই সংখ্যা ৩,৫০০ ছাড়িয়ে যাবে।”
পরে আক্রান্ত হতে পারেন, এই ভয়ে অনেকে কমিশনের কাছে গুমের অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান।
“আমি আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, আপনারা দ্বিধাহীন চিত্তে কমিশনকে আপনাদের অভিযোগ জানান। কারো সাধ্য নেই আপনাদের গায়ে আবার হাত দেয়,” অভয় দিয়ে বলেন তিনি।
গুম কমিশনে যেসব অভিযোগ জমা পড়েছে, তার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, “গুম কমিশনের সদস্যদের কাছে ভুক্তভোগীদের যে বিবরণ আমরা পেয়েছি তা অত্যন্ত মর্মান্তিক। জুলাই-অগাস্টের বিপ্লবের পর ছাত্রছাত্রীরা শহর বন্দরের দেয়ালে-দেয়ালে তাদের মনের কথা লিখেছে। তাদেরও আগে যারা গুমের শিকার হয়েছে, প্রতিটি গোপন আস্তানার দেয়ালে-দেয়ালে তারা লিখে গেছেন তাদের কষ্টের মর্মস্পর্শী বিবরণ। তাদের এসব কষ্টের কথা শুনে আমাদের হৃদয় কেঁপে উঠেছে।
“এসবের সঙ্গে জড়িতদের আমরা বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাবই। অভিযুক্ত যতই শক্তিশালী হোক, যে বাহিনীরই হোক তাকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কেবল দেশে নয়, গুম, খুন ও জুলাই-অগাস্ট গণহত্যার সাথে জড়িতদের আমরা আন্তর্জাতিক আদালতেও বিচারের উদ্যোগ নিয়েছি। ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্টের প্রধান কৌঁসুলি করিম খানের সঙ্গে আমার এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে কথা হয়েছে।”
ইউনূস বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কোনো সদস্য কিংবা অন্য কেউ যাতে হত্যা, গুমসহ এ ধরনের কোনো অপরাধে জড়িয়ে পড়তে না পারে এজন্য আমরা গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করেছি। আপনারা দেখেছেন, জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ফলকার তুর্ক সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করেছেন।
“জাতিসংঘ জুলাই-অগাস্ট হত্যাকাণ্ডের তদন্তে আমাদের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই তারা আমাদেরকে তাদের রিপোর্ট হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অতীতের গুমের ঘটনাগুলোর তদন্ত কাজেও আমরা নিয়মিত তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছি। মানবাধিকার রক্ষায় সহযোগিতা করতে ঢাকায় তারা তাদের জনবল বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। আমরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছি।”
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর কোন পরিস্থিতিতে দেশের দায়িত্ব নিতে হয়েছে, তা ভাষণে তুলে ধরেন প্রধান উপদেষ্টা।
তিনি বলেন, “আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রথম ১০০ দিন অতিক্রম করলাম। আপনারা জানেন কী কঠিন এক পরিস্থিতিতে আমাদের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট সরকার প্রধান পালিয়ে গেলে দেশ সরকার-শূন্য হয় সাময়িকভাবে। পুলিশ প্রশাসন ও এসময় সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে উদ্বেগজনক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। স্বৈরশাসনে বিপর্যস্ত এই দেশকে আমাদের সবাইকে মিলে পুনর্গঠন করতে হচ্ছে।”
মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ”বিপ্লব চলাকালে প্রায় দেড় হাজার ছাত্র-শ্রমিক জনতার শহীদী মৃত্যু হয়। সরকার প্রতিটি মৃত্যুর তথ্য অত্যন্ত যত্নের সাথে জোগাড় করছে। এই বিপ্লবে আহত হয়েছে ১৯,৯৩১ জন। আহতদের জন্য ঢাকার ১৩টি হাসপাতালসহ বিভিন্ন বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”