মোহাম্মদ নাজিম, হাটহাজারী »
বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ খ্যাত প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদীর বর্তমান অবস্থা ভালো নয়। ফলে প্রজনন মৌসুমে অনুকূল পরিবেশ তৈরি না হওয়ায় এখনো ডিম ছাড়েনি মা মাছ। হালদা কার্প জাতীয় মাছের (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) একটি অন্যতম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র।
এপ্রিল-জুন মাসে (বাংলা মাসের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ) প্রজনন মৌসুমে অমাবস্যা ও পূর্ণিমার তিথিতে যদি বজ্রপাতসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি হয়, পাহাড়ি ঢল নেমে পানিতে তীব্র স্রোত সৃষ্টি করে এবং পানির তাপমাত্রা কমে (২৭-২৯) ডিগ্রি সেলসিয়াস ও বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক প্যারামিটারের মিতস্ক্রিয়তায় হালদা নদীতে কার্পজাতীয় মাছের ডিম ছাড়ার প্রাকৃতিক অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তবে মা মাছ ডিম ছাড়ে। হালদা নদীতে মা-মাছে ডিম দেওয়ার পর প্রায় ৫শ থেকে ৬শ জন স্থানীয় ডিম সংগ্রহকারী এসব ডিম সংগ্রহ করে। এরপর মাটির তৈরি কুয়া বা হ্যাচারিতে ফুটিয়ে পোনা উৎপাদন করা হয়।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন ও মনুষ্যসৃষ্ট বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক কর্মকা- যেমন- দূষণ, জাল, বড়শি ও বিষ দিয়ে অবৈধ মৎস্য শিকার, অবৈধ বালু উত্তোলন, চরকাঁটা, হালদার উজানে ভুজপুর ও হারুয়ালছড়ি রাবার ড্যাম, ধুরুং খালের উপর কনক্রিট ড্যাম, হালদা ও এর বিভিন্ন শাখা খালসমূহ পলি জমে ভরাট হওয়া ইত্যাদি কারণে হালদার অবস্থা তথা জলজ পরিবেশ আজ হুমকির সম্মুখীন। যার সরাসরি প্রভাব পড়ছে হালদার মৎস্য সম্পদের উপর। এর প্রভাবে গত দুই বছর (২০২১ ও ২০২২) হালদা থেকে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ ব্যাপক হারে কমেছে।
গতকাল শনিবার বিকালে হালদা নদীর গবেষক ও চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজের জীববিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. শফিকুল ইসলাম সুপ্রভাতকে বলেন, বর্তমানে হালদা নদীতে চলছে মেজর কার্পজাতীয় মাছের ভরা প্রজনন মৌসুম। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট উচ্চ তাপমাত্রা ও বজ্রসহ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় হালদা নদীতে ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি না হওয়ায় চলতি মাসের (১৮-২২ এপ্রিল) সাম্ভাব্য অমাবস্যার জো’তে ডিম ছাড়েনি মামাছ।
মেজর কার্পজাতীয় মাছের অনুকূল তাপমাত্রা হচ্ছে (২২-৩০) ডিগ্রি সেলসিয়াস। তবে এরা অল্প সময়ের জন্য সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা সহ্য করতে পারে। কার্প জাতীয় মাছের প্রজনন আচরণ পানির তাপমাত্রার সাথে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত।
হালদার বর্তমান পরিবেশ মা-মাছের ডিম ছাড়ার উপযোগী কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) হালদা নদীর সাত্তারঘাট থেকে মদুনাঘাট পর্যন্ত বিভিন্ন অংশ (সাত্তারঘাট, অঙ্গুরীঘোনা, আজিমারঘাট, নাপিতেরঘাট, আমতুয়া, রামদাসমুন্সির ঘাট ও মদুনাঘাট) থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে সরাসরি হালদা নদীতে ও নিজস্ব হালদা ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখা যায়, পানির বিভিন্ন ভৌত ও রাসায়নিক প্যারামিটারের (দ্রবীভূত অক্সিজেন, পিএইচ, কার্বনডাই-অক্সাইড, ক্যালসিয়াম, ট্র্যান্সপারেন্সি, খরতা, ও ক্ষারকত্ব ইত্যাদি) মান আদর্শ মানের মধ্যে রয়েছে। তবে কার্পজাতীয় মাছের প্রজননের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু প্যারামিটার যেমন পানির তাপমাত্রা (৩২.৪-৩৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, আদর্শ মান: ২০-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং লবণাক্ততা (০.২-১.৫ পিপিটি, আদর্শ মান: ০.৫ পিপিটি), টিডিএস (১৯০-১৫০৭ পিপিএম, আদর্শ মান-১০০০ পিপিএম), এবং ইলেকট্রিক্যাল কনডাক্টিভিটি (৩৭৯-৩০১৩ মাইক্রোসিমেন্স/সেন্টিমিটার, আদর্শ মান-৩৫০ মাইক্রোসিমেন্স/সেন্টিমিটার) আদর্শ মান অতিক্রম করেছে।
হালদা নদী নিয়ে পিএইচডি করা এই গবেষক বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট সাময়িক এই তাপমাত্রা ও সামান্য লবণাক্ততা হালদায় কার্পজাতীয় মাছের প্রজননে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। কারণ মেজর কার্প জাতীয় মাছ সর্বোচ্চ ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রা এবং সহজে ৫ পিপিটি এমনকি সর্বোচ্চ ১৪ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে। তাছাড়া কয়েকদিনের মধ্যে বৃষ্টি হলে বিদ্যমান উচ্চ তাপমাত্রা, সামান্য লবণাক্ততা ও অন্যান্য প্যারামিটারসমুহ স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে মা মাছের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। পরিবেশ অনুকূলে থাকলে অর্থাৎ বজ্রপাতসহ পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢল নেমে আসে তাহলে আগামী পূর্ণিমার জো’তে অর্থাৎ মে মাসের প্রথম সপ্তাহে (২-৭) তারিখ হালদা নদীতে কার্পজাতীয় মা মাছের ডিম ছাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
আগামী পূর্ণিমার জো’তে পরিবেশ অনুকূলে না থাকলে পরবর্তী অমাবস্যার জো অর্থাৎ (১৬-২১) মে অথবা পূর্ণিমার জো (১-৬) জুন অথবা (১৫-২০) জুন অমাবস্যার জো’তে মা মাছ ডিম ছাড়বে।