আনন্দবাজার:
করোনাভাইরাসকে হারিয়ে দেওয়ার অন্যতম শর্ত হল হার্ড ইমিউনিটি বা গোষ্ঠীবদ্ধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা, এমনটাই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। লকডাউন করলে সংক্রমণটা খানিকটা আয়ত্তের মধ্যে থাকবে বলে বিশ্বাস করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু সে ক্ষেত্রে লকডাউন প্রকৃত অর্থে কার্যকর হওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তাঁরা। ধরে নেওয়া হয়, সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকলে এমন একটা সময় আসে, যখন জনসংখ্যার বাকি অংশের মধ্যে সংশ্লিষ্ট জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়ার প্রতিরোধশক্তি গড়ে ওঠে। সত্যিই কি তাই? ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব কেমিক্যাল বায়োলজির বিজ্ঞানী, ইমিউনোলজিস্ট দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলল আনন্দবাজার ডিজিটাল।
করোনার ক্ষেত্রে ইমিউন রেসপন্স কী ভাবে কাজ করে?
এই নভেল করোনাভাইরাস সারা বিশ্ব জুড়েই দ্রুত গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়েছে। প্রথমে যদিও সংশয় ছিল, এর বিরুদ্ধে যথেষ্ট ইমিউন রেসপন্স (শরীরের কোষে এবং রক্তে উপস্থিত কোনও বস্তুকে শরীর যখন চিহ্নিত করতে পারছে না বা অচেনা কিছু বলে ভাবছে, তখন একটা প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়) রয়েছে কি না। কিন্তু গত ছয় মাস ধরে দেখা গিয়েছে, ভাইরাসের বিরুদ্ধে যথেষ্ট পরিমাণে ইমিউন রেসপন্স রয়েছে। অ্যান্টিবডি তৈরি হয়েছে। টি সেলগুলিও যুক্ত রয়েছে একই সঙ্গে। সম্প্রতি ব্রিটেনের একটি রিপোর্টে দেখা গিয়েছে ২-৩ মাস পর অ্যান্টিবডি রেসপন্স (শরীরে বাইরে থেকে কোনও বস্তু প্রবেশ করলে, সেই অ্যান্টিজেনের কারণে শরীরে একটি প্রতিক্রিয়া বা রেসপন্স তৈরি হয়, ফলে দ্রুত অ্যান্টিবডি তৈরি হয়) থাকে না।
গত ৯ মাসে সংক্রমণের সংখ্যা আড়াই কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে সারা বিশ্বে। তবে এক বার সংক্রমণ হলে অন্তত ৯ মাস সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা নেই বলা যেতেই পারে। দেখা যাচ্ছে সংক্রমণের ২-৩ মাসের মধ্যে অ্যান্টিবডি রেসপন্স হ্রাস পেয়েছে। সেটা নিয়ে একটা আশঙ্কার আবহও তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর থেকে এটাই বোঝা যায় যে, অ্যান্টিবডি তৈরি করা বি সেলের মতোই টি সেলগুলিও সার্স কোভ-২-র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জরুরি ভূমিকা পালন করেছে, কারণ মাথায় রাখতে হবে পুনঃসংক্রমণের পরিসংখ্যান খুব বেশি নয়। ভ্যাকসিন তৈরি করছেন যে বিজ্ঞানীরা, তাঁদের ক্ষেত্রে এই তত্ত্ব অত্যন্ত জরুরি।
কেন গোষ্ঠী বদ্ধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জরুরি ?
গোষ্ঠীবদ্ধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সুরক্ষা প্রদান করে। সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা যাঁদের মধ্যে বেশি, হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হলে তাঁরা রক্ষা পাবেন অনেকটাই। হার্ড ইমিউনিটি তৈরি হলে সংক্রমণের হারও কমবে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে এই হার্ড ইমিউনিটি কত দিন সুরক্ষা দেবে সেই সময়টা খুব স্পষ্ট নয়। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী সেটা হল নয় মাস, কারণ গত নয় মাসে আশঙ্কাজনক মাত্রায় পুনঃসংক্রমণের কোনও প্রমাণ পাইনি আমরা। যদি আমি আরও মাস দু’য়েক পর সেই অর্থে বিশাল কোনও পুনঃসংক্রমণের খবর না আসে, তা হলে তখন ধরে নেওয়া যাবে সময়কালটা আসলে ১১ মাস। আর কোনও উপায় এই মুহূর্তে বিজ্ঞানীদের কাছে নেই।
এত দ্রুত গতিতে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার কারণ হল Ro মান (অর্থাৎ এক জন সংক্রামিত মানুষ গড়ে কতজন সুস্থ মানুষকে সংক্রামিত করতে পারেন তার পরিমাপ) অনেক বেশি হওয়া। এর ফলেই হার্ড ইমিউনিটির ম্যাজিক নম্বরটাও খুব দ্রুত সন্ধান পাওয়া যাবে অর্থাৎ গোষ্ঠীবদ্ধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। কিন্তু একমাত্র দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধক্ষমতা হলেই এটা কার্যকর হবে।
হার্ড ইমিউনিটি কি ভ্যাকসিনের আগে হবে?
ভাইরাস যে ভাবে দ্রুত সংক্রমণ ছড়াচ্ছে, সফল ভ্যাকসিন তৈরিতে যতটা সময় লাগে, এই দুটি বিবেচনা করে দেখলে হার্ড ইমিউনিটিই এগিয়ে থাকবে। অর্থাৎ একটা সঠিক ভ্যাকসিন আসার আগেই তৈরি হয়ে যাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। হয়তো অনেক বিশেষজ্ঞ এতে সহমত হবেন না, কিন্তু একবার গোষ্ঠীবদ্ধ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়ে গেলে, পরবর্তীতে এটা সহায়ক হবে। যদিও সে ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার সময়কালটাও তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ হতে হবে।
হার্ড ইমিউনিটি দ্রুত তৈরি হতে পারে কি? হলে কী ভাবে?
বড় সংখ্যক জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সুরক্ষাপ্রদানকারী রোগপ্রতিরোধ শক্তি হিসাবে গোষ্ঠীবদ্ধ রোগ প্রতিরোধ শক্তি বা হার্ড ইমিউনিটি গড়ে ওঠে. প্রাকৃতিকভাবে সংক্রমণের ফলেও হতে পারে কিংবা ভ্যাকসিন থেকেও। হার্ড ইমিউনিটিতে পৌঁছে যাওয়ার সময়কাল সংক্রমণ কতটা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে তার সঙ্গে সমানুপাতিক এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে সেটি ভ্যাকসিন দিতে পারা গেল কতজনকে তার সঙ্গে সমানুপাতিক । জনসংখ্যার কতটা অংশে রোগ প্রতিরোধ শক্তি তৈরি হলে তা গোষ্ঠীবদ্ধ অর্থাৎ হার্ড ইমিউনিটি তৈরিতে সহায়ক হয়, এই নিয়ে গাণিতিক মডেলও রয়েছে।
সার্স কোভ-২ কেসের সাধারণত ৬০-৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে মান আলাদা আলাদা হয়। দীপ্যমানবাবু বলেন, তাঁর ধারণা, এই মডেলের ক্ষেত্রে ধরা হচ্ছে জনসংখ্যার সব সদস্যই সমানভাবে সংক্রমিত হতে পারেন। কিন্তু এমনটা ঠিক নয় বলেই মনে হয়। জনগোষ্ঠীর অধিকাংশই সংক্রমিত না হতেও পারেন শুধুমাত্র তাঁদের জীবনযাপনের জন্য। যেমন বাড়ির বয়স্ক সদস্যরা। তা হলে তো লক্ষ্যমাত্রাটা আরও কমে যাচ্ছে।
কেন এই রোগ নিয়ে এত আতঙ্ক ছড়িয়েছে? দ্রুত ছড়িয়ে যায় বলে?
অবশ্যই। সভ্যতার ইতিহাসে আসলে খুব কম উদাহরণ রয়েছে যেখানে একটা রোগ এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। দুই মাসে সাতটা মহাদেশ এবং আট মাসে প্রায় দুই কোটি মানুষের মধ্যে সংক্রমণ হয়েছে। আতঙ্কের একটা বড় কারণ অনিশ্চয়তা। বোঝা যাচ্ছে না যে কাদের ক্ষেত্রে রোগটা মারাত্মক হবে, কাদের ক্ষেত্রে নয়। বাচ্চারা খানিকটা হলেও কম আক্রান্ত এটা একটা ভাল দিক। রোগের ভয়াবহতার পরিমাণ মহিলাদের ক্ষেত্রে খানিকটা কম।
এই রোগের ক্ষেত্রে বিশ্বে মৃত্যুর হার আর সুস্থ হওয়ার হার কেমন?
বিশ্বে এই মুহূর্তে আড়াই কোটিরও বেশি নথিভুক্ত সংক্রমণ রয়েছে। প্রায় দুই কোটি মানুষ সেরে উঠেছেন। ৭ লক্ষেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর হার ৫ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু এই গণনার সময় এটা মনে রাখতে হবে, কত জন আক্রান্ত আর কত জনের মৃত্যু হয়েছে। জনসংখ্যার একটা বড় অংশ কিন্তু আক্রান্ত। তবে সেই অর্থে কোনও উপসর্গ নেই এবং পরিসংখ্যানে স্থান মেলেনি তাদের, মনে রাখতে হবে এ কথাও। কাজেই আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হচ্ছে, তার চেয়ে মৃত্যুর হারটা আরও কম।
এই রোগটা কি আর পাঁচটা ফ্লু-এর মতই?
একেবারেই না। অন্য ফ্লু-এর ক্ষেত্রে এত দ্রুত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে না বা আক্রান্তদের এত জনের মধ্যে এত ভয়বাহতা দেখা যায় না।
সার্স কোভ ২ কি অন্য ফ্লু ভাইরাসের থেকে বেশি ক্ষতিকারক?
হ্যাঁ বলেই মনে করা হচ্ছে। কারণ যাঁদের ক্ষেত্রে ভয়াবহতা বেশি, তাঁরা অনেক বেশি অসুস্থ হয়েছেন। এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি, সেরে উঠলেও কী ধরনের ক্ষতি হচ্ছে এই রোগে যা আসলে দীর্ঘস্থায়ী। তাই এই নিয়ে বিশদে আরও গবেষণা প্রয়োজন।
সুতরাং, ভ্যাকসিন যত দিন আসছে না, তত দিন গোষ্ঠী সংক্রমণ থামিয়ে রাখা তো যাবে না। কাজেই সে ক্ষেত্রে আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে সেটা বুঝে নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।