হাতি ও চামচিকা

বিচিত্র কুমার »

এক সময়ের কথা। খুব গভীর এক বনে বাস করত এক বিশাল হাতি। নাম ছিল হিমু। তার রং ধূসর, গলা ভারী, আর হেঁটে চলার শব্দে কেঁপে উঠত জমিন। সে ছিল খুব অহংকারী। ভাবত বনের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রাণি সে। যাকে ইচ্ছা ধমক দিত, যার ওপর ইচ্ছা করে পা ফেলত, কেউ কিছু বলত না।
একদিন দুপুরে হিমু চলছিল বনের ভিতর দিয়ে। তখন হঠাৎ তার ডান পায়ের নিচে এসে পড়ল এক ছোট্ট চামচিকা, নাম ছিল চুমি। সে ছিল একদম টিপটিপে ছোট, কিন্তু বুদ্ধিতে বেশ তীক্ষ্ণ।
চুমি যন্ত্রণায় ছটফট করে কেঁদে উঠল, ‘হায়! কে এমন করে পা ফেলল! আমি তো মরে যাচ্ছি!’
হিমু নাক সিঁটকে বলল, ‘ওহ! তোরা আবার কিসের জীব! তোর মতো ছোট প্রাণি বেঁচে থাকতেও চায়?’
চুমি কষ্টে বলল, ‘তুমি বড় বলে ছোটদের অপমান করবে? আমরা ছোট হলেও মন আছে, প্রাণ আছে, সম্মান আছে। তুমি বুঝবে না…’
হিমু হেসে উঠল, ‘তোর মতো একটা চামচিকা আমাকে শিক্ষা দেবে? থাক, জীবনটা যত ছোট, কথাগুলো তত বড়!’
চুমি আর কিছু বলল না। সে ধীরে ধীরে উঠে এল হিমুর পা থেকে, শরীরের ধুলোমাটি ঝাড়ল আর কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। এরপর সে এক অভিনব পরিকল্পনা করল।
সন্ধ্যার সময় হিমু যখন জলের ধারে দাঁড়িয়ে জল খাচ্ছিল, চুমি গিয়েই বাকি চামচিকা দলকে ডেকে আনল। তারা সবাই মিলে গাছের ওপর থেকে হিমুর কানে গিয়ে ঢুকল। কিছু ঢুকল তার শুঁড়ে, কিছু বসল চোখের কোণায়। হিমু আঁতকে উঠে চিৎকার করে উঠল, ‘ওরে বাবা! কী হল! কে কোথা থেকে কামড়াচ্ছে!’
চুমি তখন বলল, ‘তুমি যদি মনে করো আমরা ছোট, তাহলে এ কামড়কে বাতাস ভাবো। আর যদি বুঝতে পারো তবে বলো, ক্ষমা চাইবে কিনা!’
হিমু লাফিয়ে দৌড় দিল। জল, কাদা, পাথর কিছুই খেয়াল করল না। বনের সবাই দৌড়ে এলো দেখতে হাতির এই হাল কেন? হিমু গাছের নিচে পড়ে হাঁপাচ্ছে আর বলছে, ‘ওরে বাবা! আমি ভুল করেছি! আমি আর অহংকার করব না!’
চুমি নিচে নেমে এসে তার চোখের সামনে দাঁড়াল। ‘তুমি বড় বলেই সবাই তোমাকে ভয় পায়। কিন্তু ভয় দেখানো আর শ্রদ্ধা পাওয়া এক নয়, হিমু ভাই।’
হিমু চোখ মুছল, ধীরে ধীরে মাথা নিচু করল, বলল, ‘তুমি ঠিক বলেছ চুমি। আজ আমি সত্যিই বুঝলাম, ছোটরাও অনেক কিছু পারে।’
সেদিন থেকে হিমু বদলে গেল। আর কারো ওপর জোর খাটাত না। পথ চলতে ছোটদের দেখলে সাবধানে পা ফেলত। এমনকি যেদিন চুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিল, হিমুই গিয়ে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিল তাকে।
বনের সবাই অবাক হয়ে দেখল আগে যাকে কেউ ভালোবাসত না, এখন সবাই তার বন্ধু। আর হিমু বুঝতে পারল বন্ধু হতে হলে বড় শরীর নয়, বড় মন দরকার।
এভাবেই চামচিকা চুমি আর হাতি হিমুর বন্ধুত্ব গড়ে উঠল। বড় আর ছোট একসাথে হাসি-আনন্দে কাটিয়ে দিল জীবনের প্রতিটি দিন।