ড. মো. মোরশেদুল আলম »
রাজা-বাদশাহগণ রাজত্ব করতেন রাজ্যের উপর আর সুফি-সাধকরা রাজত্ব করেন মানুষের হৃদয়ের উপর। একথা হৃদয়াবেগও নয়, কল্পনা বিলাসিতাও নয় একথা বাস্তব। সুফি-দরবেশগণ তাঁদের অতুলনীয় চরিত্র ও সত্যনিষ্ঠা এবং ঈমান ও তাক্ওয়ার বলে বলীয়ান হয়ে যে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা উচ্চ-নীচ সব মানুষের নিকট থেকে পেতেন, তা রাজা বাদশাহগণের ভাগ্যেও জুটতো না। কারণ তরবারির ভয় দেখিয়ে শ্রদ্ধা-ভক্তি ও ভালোবাসা অর্জন সম্ভব নয়। কাজেই মনোরাজ্যের রাজাই হলেন প্রকৃত রাজা, যিনি এক আল্লাহ ছাড়া আর কারো নিকট বশ্যতা স্বীকার করেন না। সুফিরাই ছিলেন প্রকৃত আলেম; যাঁরা আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টি রহস্যের জ্ঞান লাভ করার জন্য এলেম বা বিদ্যা অর্জন করতেন। কুরআন, হাদিস, ফিকহ, তাসাউফ প্রভৃতি জ্ঞান অর্জনের উদ্দেশ্য হচ্ছে নিজের হৃদয়ের শুদ্ধি, পবিত্রতা লাভ করা ও জ্ঞানালোকে হৃদয়কে উদ্ভাসিত করা। এ কারণেই তাঁদের আলেমে হাক্কানী বা রাব্বানী বলা হয়। সুফিরা ধর্মীয় চিন্তা ও কর্মের উদ্দেশ্য ও উপলব্ধিকে উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করেন।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতিষ্ঠিত ইসলামের যে আদর্শ ও ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছিল, পরবর্তী সময়ে অনেকটা নিষ্প্রভ হয়ে পড়েছিল; তখনই সুফি সাধকরাই তা পুনরুদ্ধার করতে সমর্থ হন।
সুফিতত্ত্বের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি পুঁথিগত বিদ্যা নয়। এটি উপলব্ধি হয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা, হাল এবং নৈতিক পরিবর্তন দ্বারা। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলতে সুফিরা বুঝতেন তাঁদের আরাধ্য পরম প্রেমাস্পদ আল্লাহর সঙ্গে নিবিড় সান্নিধ্য। হাল বলতে তাঁরা বুঝতেন তপস্যার মধ্যে, আল্লাহর ধ্যানের মধ্যে মানুষ যখন কায়মনোবাক্যে নিমগ্ন হতে পারে এবং যা সকল ভাবনা-কামনা থেকে উর্ধ্বে উঠতে পারে। তখনই তাঁর বাহ্যজ্ঞান ও চেতনা লুপ্ত হয়ে গিয়ে এক অনির্বচনীয় আনন্দময় অনুভূতি লাভ করে। তখন সে ও তাঁর প্রেমাস্পদ আল্লাহর মধ্যে সকল ব্যবধান ও বাধা অন্তর্হিত হয়। জগত-সংসার ভুলে এ যেন দু’জনের মুখোমুখি ভাব।
উইলিয়াম হান্টার লিখেছেন, প্রকৃতপক্ষে সুফিদের তথা ইসলামের জনপ্রিয়তা ও সাফল্য ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ আদর্শ ও মহত্তর জীবনবোধের জন্যই সম্ভব হয়েছিল। তরবারি দ্বারা এ বিজয় কখনো সম্ভব হয়নিÑ এ বিজয় ছিল আদর্শের বিজয়।
অহং বা আমিত্বের বন্ধন থেকে মুক্তি পেয়ে তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছায় নিজেদেরকে সম্পূর্ণরূপে, নিঃশেষে নিবেদন করতেন। এই যে নিবেদন চিত্ততা, সুফি সাধকের মহৎ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সুফিদের উদারতা, সহনশীলতা ও মানবিকতার গুণে সমগ্র উপমহাদেশে অমুসলিম জনগণ তাঁদের প্রতি আকৃষ্ট হয়। তাঁদের অবদানের কারণেই বাংলাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্ভব হয়েছে। তেমনই একজন সুফি-সাধক হযরত শেখ সৈয়দ শাহজাহান শাহ্ (রা.)। তিনি এমন এক মানবকল্যাণকামী মনীষী যাঁর সমগ্র জীবন মানবতার জন্যই নিবেদিত। জীবদ্দশায় যেমন ছিলেন, তেমনি ওফাতের পরও তিনি মানবকল্যাণে নিবেদিত। তিনি প্রেম ও কালিমামুক্ত অন্তরে প্রাপ্ত ঐশ্বরিক প্রেরণার সত্য ও সৌন্দর্যস্বরূপ।
হযরত শাহজাহান শাহ্ (রা.) একজন উচ্চ মার্গের অলি ও সুফি সাধক ছিলেন। সুফিগণের আগমনে চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন ঘটে এবং তাদের ধ্যান-সাধনায়, অলৌকিক ক্রিয়াকলাপে অনেক লোক ইসলাম ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তারা তা গ্রহণ করে। সুফিরা আধ্যাত্মিক সাধক। আধ্যাত্মিক সাধনায় উচ্চ মার্গে উন্নীত সাধক ইচ্ছে করলে অলৌকিকভাবে মানবজগতের উপকার সাধন করতে পারেন। আমার যা অনুভূতি তাতে মনে হয়, হযরত শাহজাহান শাহ্ (রা.) সেই রকম আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্য দিয়ে মানসিক বিভিন্ন উন্নত স্তরে পৌঁছেছিলেন। যার জন্য তিনি ‘জিন্দা অলি’ নামে পরিচিত।’
তিনি ইয়েমেন থেকে স্থল ও জল পথ ধরে দীর্ঘ পথ পরিক্রমার পর লাহোর-দিল্লী-গৌড় হয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানার তদানীন্তন ‘ইল্লা’ নামক স্থানে ডিঙ্গি নৌকা থেকে অবতরণ করেন। ওই স্থানে মাটিতে পদার্পণ করে তিনি কালেমা উচ্চারণ করে মাটিতে স্বীয় হাতে থাকা লাঠি স্থাপন করেন। তাঁর পবিত্র জবানে উচ্চারিত কালেমার সূত্র ধরে ওই স্থানটি লোকমুখে ‘ইল্লা’ নামে পরিচিত। তিনি ওই স্থানে কিছুকাল অবস্থান করে বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করে হাটহাজারী থানার অন্তর্গত কাটিরহাটে আগমন করে পার্শ¦বর্তী ‘মোগল কিল্লা’ নামক স্থানের ‘কোডের পাড়ে’ এসে তাঁর আস্তানা তৈরি করেন।
স্থানীয় প্রয়াত সাংবাদিক ওবায়দুল হকের বর্ণনা অনুযায়ী, এই কোডের পাড় ছিল মূলত জঙ্গলে পরিপূর্ণ। কোডের পাড়ের বুক চিরে যাওয়া রাস্তার দক্ষিণ পাশে জঙ্গলের মধ্যে স্থানীয় ভাষায় ‘ফইরের টাইক্কা’ অর্থাৎ ফকিরের তাকিয়া অবস্থিত। মুলত ফকির তাকিয়া বলা হতো হযরত শাহজাহান শাহ (র.) আস্তানাকে।
হযরত শাহ জাহান শাহ্ (রা.) আস্তানা শরিফে থাকাকালীন তাঁর সম্মুখে, কখনও তাঁর দুই পাশে এবং সামনে কয়েকটা বাঘ বসে তাঁর দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে থাকত এবং পর্যায়ক্রমে প্রতিটি বাঘ হযরত শাহজাহান শাহ্ (র.)-এর কনিষ্ঠ আঙ্গুলি লেহন করত। তখনকার ‘ফইরের টাইক্কা’ থেকে পাহাড়ের দূরত্ব ছিল মাত্র এক থেকে দেড় কিলোমিটার। বাঘ স্বল্প সময়ের মধ্যে পাহাড় থেকে তাঁর নিকট আসা-যাওয়া করতে পারত। বাঘ লোকালয়ের পাশ দিয়ে আসা-যাওয়া করলেও কখনও কারো কোনো ক্ষতি করেনি। হযরত শাহজাহান শাহ্ (রা.)-এর পদধূলি পেয়ে ধন্য ‘কোডের পাড়কে’ ‘কোটের পাড়ও’ বলা হয়ে থাকে। উক্ত কোটের পাড়ের পাশে একটি হাট গড়ে উঠে, যা পরবর্তীতে ‘কাটিরহাট’ নামে রূপান্তর ঘটেছে। কাটিরহাট সংলগ্ন ফকিরের তাকিয়ার এই আস্তানায় বসে তিনি এই অঞ্চলের ইসলাম প্রচার-প্রসারে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে পরলোকগমন করেন।
সুফি সাধকরা কেবল তাঁদের আত্মোৎকর্ষ লাভের জন্যই নিজেদের নিয়োজিত করেন না, তাঁরা ইসলামের জন্য এবং মানবসেবার জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেন। মানবসেবাকে তাঁরা স্রষ্টার প্রতি গভীর প্রেম ও নিষ্ঠারূপে বিবেচনা করে থাকেন। মহান সুফি সাধক হযরত শাহজাহান শাহ্ (রা.) এমন এক সুফি সাধক ও আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব যাঁর জীবন ও কর্ম মানবতার জন্য উৎসর্গিত।
শিক্ষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়