কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম »
সারাদেশে সড়ক দুর্ঘটনা মহামারি রূপ নিয়েছে। বলা চলে এটি একটি জাতীয় দুর্যোগ। মানুষ মারা যাচ্ছে কেবল তা নয় দুর্ঘটনাগ্রস্ত পরিবারগুলোতেও চলে শোকের মাতম। স্বজন হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয় তারা। প্রতিনিয়ত সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে বহু মানুষ। আহত হচ্ছে হাজারে হাজার।
দেশে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হার দুই-ই বাড়ছে। বেসরকারি সংগঠন ‘নিরাপদ সড়ক চাই’(নিসচা) এর হিসাবে গত বছর ৪৭০২টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে মারা গেছে ৫২২৭ জন। এর আগের বছর ৩১০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৪৪৩৯ জন মারা যায়। দেখা যাচ্ছে, এক বছরে সড়কে দুর্ঘটনা বেড়েছে ১৫৫৯টি এবং প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েছে ৭৮৮জন। প্রাণহানি বৃদ্ধির হার ১৮ শতাংশ। প্রতিদিন গড়ে ১৮জনের বেশি মারা গেছে। এক বছরের ব্যবধানে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও মৃত্যুর হারে এই বৃদ্ধি অত্যন্ত উদ্বেগজনক।
অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, সড়ক-মহাসড়কের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়াও নিরাপদ নয়। কখন চাকার নিচে চাপা পড়ে সে শংকায় থাকতে হয়। নিজের সচেতনতা নিজেরই হওয়া ছাড়া কোন উপায় নেই! মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে দেশের সড়ক-মহাসড়কগুলো। বাস, ট্রাক দুর্ঘটনার পাশাপাশি বাইক দুর্ঘটনাও ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে উঠতি বয়সের তরুণ, যুবকদের অনেকে শখের বশে বেপরোয়া হয়ে স্কুটার চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনায় পড়ে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে চাকরি, ব্যবসাসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ কাজে বাইরে যেতে হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয় শিক্ষার্থীদের। পথে দুর্ঘটনার ভয় থাকলেও একপ্রকার জানবাজি রেখেই চলতে হয়। কোন উপায় নেই। গাড়িচালকদের কথা কী বলব! ‘যেভাবেই হোক অপর গাড়িকে ওভারটেক করে এগুতে হবে’-এমন মানসিকতা নিয়েই তারা গাড়ি চালান অনেক চালক।
সড়ক দুর্ঘটনা এদেশে একটি মানবসৃষ্ট মহাদুর্যোগ। যা প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে কোন পক্ষ থেকেই কার্যকর তেমন কোন পদক্ষেপ চোখে পড়েনা, দায়সারা কিছু ব্যবস্থা নিয়েই শেষ! বিভিন্ন বেসরকারি ও সামাজিক সংগঠন এ ‘দুর্যোগ’ থেকে মানুষকে রক্ষার জন্য জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করে থাকে। কিন্তু তা তেমন কার্যকরী নয়। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে কার্যকর ও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে গাড়ি চালকদের মাঝে সচেতনতা তৈরির পদক্ষেপ নিতে হবে। দায়ী চালকদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। নিষিদ্ধ করতে হবে গাড়ি চালানোর সময় চালকদের মোবাইলে কথাবার্তা বলা। মানুষ মারার পরও যখন দেখা যায় গাড়ি চালক সদর্পে ঘুরে বেড়ায় তখন ভয়টা বেড়ে যায়। আইনে পরিবর্তন এনে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদ-র’ বিধান কার্যকর করতে হবে। রাস্তায় যেন কোন ধরনের লক্কর-ঝক্কর মার্কা কিংবা দুর্বল ইঞ্জিনের যান চলাচল করতে না পারে সে ব্যাপারে কঠোর হতে হবে। রাস্তার মাঝে গাড়ি ঘোরানোর মতো অন্যায়কে কোনভাবেই প্রশ্রয় দেয়া যাবে না। নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যানবাহনের বেপরোয়া গতি। নেশা করে যেন কোন চালক গাড়ি চালাতে না পারে সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। পাল্লা দিয়ে ‘ওভারটেকিং’ করা বন্ধ করতে হবে। চোখে ঘুম নিয়ে গাড়ি চালানো থেকে বিরত থাকতে ড্রাইভারদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার সময় চালকদের বাস্তব অভিজ্ঞতাকেই আমলে নিতে হবে। কোন অযোগ্য ও অদক্ষ চালক যেন লাইসেন্স না পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি গাড়ি চালকদের জন্য ন্যুনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা গেলে ভালো হয়। যদিও এটি বাস্তবায়নের কথা শোনা যাচ্ছে। দেশের বিভিন্ন সড়ক, মহাসড়কের পাশাপাশি স্টেশনগুলোকেও প্রশস্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে। আষাঢ়ের বৃষ্টি ও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক মহাসড়কগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নিতে হবে। একজন চালক কত মানুষের প্রাণ হাতে নিয়ে রাস্তায় গাড়ি চালান। সেই মানুষগুলোর প্রতি চালকদের দরদ থাকা উচিত। যেভাবেই হোক একজন চালককে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে সম্ভব সবকিছুই করতে হবে। ‘সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য বেশি’- একথা চালকদের মাথায় রাখতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হলো কর্তৃপক্ষের কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি। গত রোববার ছিল জাতিসংঘ ঘোষিত সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণ দিবস বা রোড ক্র্যাশ ভিকটিম ‘স্মরণÑদিবস। সড়কে দুর্ঘটনায় যারা মৃত্যুবরণ করে যাদের হারিয়ে একটি পরিবারের স্বজনদের জীবনে যে হতাশা ও করুণ পরিণতি নেমে আসে, সেই বিষাদময় ঘটনাকে স্মরণ করতে, স্বজনদের সহাসভূতি জানানো এবং সড়কে দুর্ঘটনা হ্রাসে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলা এই দিবসটি পালনের উদ্দেশ্য। দুঃখের বিষয় এই দিবসটি পালনে আমাদের কোন কর্মসূচি নেই। অথচ প্রতিদিনই সড়কে ভয়াবহ সব দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশ, গত ৫ বছরে ৩৭ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত এবং ৮২ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। কতটি মামলা হয়েছে, নিহত, আহত পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পেয়েছে কিনা তার তথ্য নেই।
সড়ক আইনটির প্রয়োগ এখনো হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস করতে সরকার, বিশেষজ্ঞরা সুপারিশ, করণীয় সম্পর্কে বললে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।
মানুষের প্রয়োজনে বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যা। প্রতিদিনই বহুসংখ্যক নতুন গাড়ি রাস্তায় নামছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনাও। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পাশাপাশি অসংখ্য মানুষ সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করছে। এই মানুষগুলোর সাথে জড়িত পরিবার ও তাদের আত্মীয়-স্বজন অবর্ণনীয় কষ্টে পড়ে। বিষয়গুলো আমাদের ভাবা উচিত বলে আমি মনে করি। সরকারি, বেসরকারি সংস্থা এবং সংশ্লিষ্ট যানবাহন কর্তৃপক্ষকে নিহত ও আহত হওয়া পরিবারগুলোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। করতে হবে সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা।
আমরা সড়ক দুর্ঘটনামুক্ত একটি বাংলাদেশ প্রত্যাশা করি। সড়কে এই মৃত্যুর মিছিল কবে থামবে? আর কত প্রাণ ঝরবে? মৃত্যুফাঁদে পরিণত হওয়া সড়কগুলোকে যেভাবেই হোক নিরাপদ করতে হবে সকলের জন্য।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক