বিবি হাওয়া স্নেহা »
নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে আপনি ট্রল করছেন? খুবই ভালো কথা! একটু খেয়াল করে দেখুন তো আপনার সাথে আর কারা ট্রল করছে!! এরা শিক্ষাক্রম বলতে কী বোঝায় তা জানে কিনা? শিক্ষাক্রমে কি আছে তা খতিয়ে দেখেছে কিনা? খতিয়ে দেখলেও তা বোঝার মত যোগ্যতা আছে কিনা? কিংবা এরা পূর্বের শিক্ষাক্রমে পড়ে, তা বাস্তবে কাজে লাগিয়ে সফল হয়েছে কিনা? নাকি শুধু লাইক, কমেন্ট পাওয়ার আশায় সস্তা বিনোদনের জন্য ভিডিও বানাচ্ছে? আপনিই বিচার করুন।
মনে করে দেখুন তো- সদ্য কথা শিখতে যাওয়া শিশুর সাথে আপনি তার মত করেই কথা বলেন-‘ওলে বাবা! দুত্তু বাবুটা আমাল!’ তার মুখের একটু হাসির জন্য আপনি কত অঙ্গভঙ্গি করেন! ঘরের ছোট্ট সদস্যের আবদারে কখনো ঘোড়া হয়েছেন কখনোবা কুমির!
‘তারে জমিন পার’ মুভিতে আমির খান যখন বিচিত্র সাজে ক্লাসে ঢুকে ‘বাম বাম বোলে’ গানে নেচে গেয়ে আনন্দ দেয়- তখন আপনার সন্তানের আনন্দমাখা মুখখানা খেয়াল করেছেন কি? আপনিও উদগ্রীব হয়েছিলেন এই আজব শিক্ষক কীভাবে শেখায় তা দেখার জন্য! এবং অবশেষে আজব শিক্ষকের সফলতা দেখে নিশ্চয়ই খুশি হয়েছিলেন?
এতক্ষণে আশা করি এটা বুঝতে পারছেন- শিশুদেরকে সহজে শেখাতে হলে তাদের মত করে আচরণ করতে হয়, তাদের বন্ধু হয়ে যেতে হয়, তাদের মন বুঝে আনন্দের সাথে পাঠদান করতে হয়। রাশভারি চেহারা নিয়ে চেয়ারে বসে কেউ কবিতা পড়ালে, রাগী চেহারা নিয়ে চোখ গোল গোল করে নামতা শেখালে বা শাস্তির ভয় দেখিয়ে শব্দের অর্থ মুখস্থ করালে- সেই শিক্ষা ফলপ্রসূ হয় না।
তাহলে শিক্ষকদের চিরাচরিত জড়তা ভেঙে নতুন কিছুর চেষ্টাকে কেন আমরা স্বাগত জানাতে পারছি না?
ইতোমধ্যেই আমরা জেনেছি – হাঁসের প্যাক প্যাক, ব্যাঙলাফ বা সাইকেলের টিডিং টিডিং- এর কোনটাই আমাদের নতুন শিক্ষাক্রমের প্রশিক্ষণের অংশ নয়। আর যদি প্রশিক্ষণের অংশ হয়ও তাহলে সমস্যা কোথায়? শিশুদেরকে আনন্দের সাথে শেখানোর জন্য শিক্ষকদের এই কাজগুলো রপ্ত করা খারাপ কিছু হতে পারেনা। তাছাড়া প্রত্যেকটা কার্যক্রমের পেছনে কোন না কোন উদ্দেশ্য আছে, যা সামান্য ভিডিওতে বোঝা নাও যেতে পারে (যেমন, হাঁসের প্যাক প্যাক ভিডিওতে মেঝেতে ছক করে ভগ্নাংশ শেখানোর পদ্ধতি ছিলো)।
আপনার সন্তান নিজে থেকে স্কুলে যেতে চাইবে, স্কুলের সময়টা আনন্দে থাকবে, হাসতে-খেলতে শিখবে- এটাতো ভালো কথা! ভেবে দেখুন- আমরাও ছেলেবেলায় এমন কিছু চাইতাম, পরীক্ষার ভয় থেকে মুক্তি চাইতাম, যে শিক্ষক ভিন্ন কোন পদ্ধতিতে আনন্দ দিয়ে পড়াতো তাকে আমরা এখনো মনে রেখেছি।
পঞ্চম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী ভিন্নভাবে শিক্ষকের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছে। বিদায় অনুষ্ঠানের চিরাচরিত কবিতা ‘যেতে নাহি দিবো হায়’ না বলে সৃজনশীলতা প্রয়োগ করে আবেগ দিয়ে গান গাইলো কেনো? আমরা হা হা হি হি… করছি!!
অথচ এই রিমেক গানের চমৎকার কথাগুলো খেয়াল করিনি! খেয়াল করিনি মূল গানটি আমাদের শেকড়কে পরিচয় করিয়ে দেয়- একসময় আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতির অন্যতম অংশ ছিলো পালাগান। আমরা ভুলে যাই এই গানের সুরে আমাদের মা-দাদি-নানিদের আবেগ জড়িত! আমরা চিন্তা করি না নেতিবাচক ট্রলের পর মেয়েটি বা তার পরিবার সমাজে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করতে পারবে কিনা!
আমরা দেখি শিক্ষার্থীরা সারা বছর রান্না করছে। দশটি বিষয়ের মধ্যে একটি বিষয় জীবন ও জীবিকা। এর ৯টি অধ্যায়ের মধ্যে একটিতে শিক্ষার্থীরা কুকিং স্কিল অর্জন করবে। উক্ত রান্নার উদ্দেশ্য শুধু রান্না শেখানো নয়!
রান্নার সময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা ও সাবধানতা, ডাল-আলু-সবজি-মাছ ইত্যাদির পুষ্টিগুণ জানা ও শারীরিক সুস্থতায় এগুলোর প্রয়োজনীয়তা,রান্নার সাথে পারিবারিক বন্ধন (মায়ের হাতের রান্না একসাথে বসে খাওয়ার মিষ্টি স্মৃতি নিশ্চই ভুলিনি আমরা),রান্নায় সৃজনশীলতা ও বৈচিত্রপূর্ণ পরিবেশন, বাড়িতে যারা রান্না করে তাদের কষ্ট অনুভব করা সর্বোপরি যেকোন পেশার প্রতি ইতিবাচক ধারণা পোষন ইত্যাদিও শিখবে।
তাছাড়া নিজের পরিবারের জন্য রান্না করলেই যদি বুয়া/বাবুর্চি হয়ে যায়, তাহলে তো আমার মা- দাদী-নানী সবাই বুয়া/বাবুর্চি! বর্তমানে যেসব নারীরা বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত- তারা সবাই গার্হস্থ্য বই পড়েই এসেছে।গার্হস্থ্য বইয়ে রান্নার অধ্যায় আগেও ছিলো। কই তারা তো বুয়া হয়ে যায় নি!
এখন একই টপিক ছেলে-মেয়ে উভয়ে পড়বে। রেস্টুরেন্টে গিয়ে আয়েস করে পুরুষ শেফের রান্না চেটেপুটে খাই। কোন শেফের একমাসের বেতনে হয়ত অনেক কর্মজীবীর গোটা বছর চলে যাবে!তাহলে আমরা কাকে ছোট করছি, কেন করছি? নাকি আমরা চাই না দরিদ্র পরিবারের কেউ এতকিছু বিনামূল্যে শিখুক?
আমরা অভিযোগ করছি- আমাদের সন্তানেরা সারাদিন ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকে! অথচ কারিকুলামের কোথাও সরাসরি নেট থেকে কপি করার কথা বলা নেই। তাও বাচ্চারা ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকে। এর কারণ, আমরা শিক্ষকরা হয়ত বিষয়গুলো ভালোভাবে বুঝিয়ে দিতে পারিনি বা অভিভাবক হিসেবেও তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারিনি। এছাড়া আমাদের সন্তানদের তথাকথিত শুভাকাক্সক্ষীরা সর্বদা ফিডার প্রস্তুত করে রাখে, যাতে শিক্ষার্থীরা আগের মত ফিডার গিলে পুনরায় ক্লাসে গিয়ে বমি করতে পারে! আমরা তাদের চিন্তার দ্বার, সমস্যা সমাধানের সুযোগ বা চেষ্টা নিজেরাই বন্ধ করে দিই।
আর ডিভাইস বা মোবাইল নির্ভরতা কিন্তু গত এক বছরে হয়নি। ছোটবেলায় খাবার খাওয়ানোর জন্য মোবাইলটা আপনিই তার হাতে প্রথম তুলে দিয়েছিলেন! আপনিই হয়ত কাজ করা বা টিভি দেখার জন্য ওর হাতে মোবাইল দিয়ে নিশ্চিন্তে ছিলেন!
আগামী বিশ্ব প্রযুক্তির। আপনার মা-বাবা যে প্রযুক্তি কল্পনাও করেননি, আপনি সে প্রযুক্তি নিয়মিত ব্যবহার করছেন। ছোটখাটো প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধানের জন্য আবার কখনো সন্তানের কাছেই ছুটে যান-‘বাবা একটু দেখ তো কী হলো’! আপনার সন্তান অবশ্যই আপনার থেকে প্রযুক্তি ব্যবহারে এগিয়ে থাকবে-এটা স্বাভাবিক। শুধু খেয়াল রাখতে হবে- সে যেন প্রযুক্তির সঠিক এবং ইতিবাচক ব্যবহার করতে পারে।
অনেকেই বলছি- এই কারিকুলামে কেউ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে না। সত্যিটা হলো- বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার মজবুত ভিত গড়ার ক্ষেত্রে মাইলফলক হবে এই শিক্ষাক্রম এবং সেই ডাক্তারকে কেউ ‘কসাই’ বলার সুযোগ পাবে না! সেই ডাক্তার হবে মানবিক! এছাড়া কেউ কি এটা ভেবেছেন- টপার কয়েকজন হয়ত ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হবে। বাকিরা কোথায় যাবে? কী করে জীবিকা নির্বাহ করবে? তাছাড়া পড়তে হয় পরিবারের পছন্দের বিষয়ে। ফলে নিজের আগ্রহের বিষয়ে চর্চাও থাকেনা যে তা দিয়ে কিছু করবে! তাছাড়া গত কয়েক বছরে মেধাবীদের লাইন ধরে দেশের বাইরে চলে যাওয়া ঠেকাতে পারছি কি? শত সমস্যার এই দেশেই আমাদের সন্তানেরা বেড়ে উঠছে, বেঁচে থাকবে। আমরা নিশ্চয় চাই- ওরা সার্টিফিকেটধারী বেকারের লম্বা লাইনে না দাঁড়িয়ে মানবিক মানুষ হোক, আনন্দে জীবন কাটাক!!
নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষকের ইচ্ছা বা পদ্ধতিকে নয়, বরং শিক্ষার্থীর পছন্দ ও আগ্রহকে প্রাধান্য দিয়েই প্রণয়ন করা হয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী, নভোচারী, প্রোগ্রামার, সাহিত্যিক, ডিজাইনার, শেফ, উপস্থাপক, শিল্পী কিংবা দক্ষ সংগঠক -যে যা হতে চায় তাকে সেই পথে হাঁটার দিকনির্দেশনা দিবে এই শিক্ষাক্রম। আমাদের শিক্ষার্থীরা নাম্বারের প্রতিযোগিতায় নামবে না বরং সহযোগিতার মাধ্যমে শিখবে, নিজেদের দক্ষতা সম্পর্কে জানবে, সমস্যা খুঁজে বের করবে এবং নিজেরাই সমাধান করতে করতে এক সময় যোগ্য একজন হিসেবে গড়ে উঠবে।
মাঠে-ঘাটে নাচের ভিডিও মানেই এটা কারিকুলামের! স্কুলড্রেস পরে নাচছে মানেই কারিকুলাম নাচতে বাধ্য করছে! দেশটা রসাতলে গেলো! চলো শেয়ার করি! এমন কেন আমরা? কারিকুলামে সত্যিই এমন কিছু আছে কিনা তা যাচাই করার মত নিজেদের বোধ-বুদ্ধি কি নেই আমাদের? দায়িত্ব নিয়ে বলছি- কারিকুলামের কোথাও বাধ্যতামূলক নাচ-গান নেই। শুধু নাচগান শেখানোর কোন উদ্দেশ্য বা এ বিষয়ক পাঠ্যপুস্তক নেই।
শিল্প ও সংস্কৃতি নামে একটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়টির মাধ্যমে শিক্ষার্থী প্রকৃতি-পরিবেশ অনুযায়ী নিজের ভাব, অনুভূতি ও কল্পনাকে সৃজনশীল উপায়ে প্রকাশ করতে পারবে এবং যাপিত জীবনে নান্দনিকতার চর্চা করা শিখবে। সেই সাথে দেশীয় সংস্কৃতিকে জানবে ও বিশ্ব দরবারে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মত যোগ্যতা অর্জন করবে। এগুলো এক্সট্রা কারিকুলাম হিসেবে এক্সট্রা টাকা দিয়ে বাইরে থেকে কেন শিখতে যাবে? সবার সেই সামর্থ্য আছে কিনা- তা কি ভেবেছি আমরা?
বছরের প্রথম দিকে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে অনেকের আপত্তি থাকলেও এখন বলছেন- বই মোটামুটি চলে কিন্তু পড়ানোর অবকাঠামোগত পরিবেশ নেই। সত্যি বলতে- জনবহুল এই দেশে আমাদের চাহিদামতো শতভাগ পরিবেশ তৈরি করতে গেলে হয়ত আরো কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে। ততদিনে আমাদের সন্তানদের কী হবে? তারচেয়ে যত একদিন আগে সম্ভব, রূপান্তর শুরু করা উচিত। সেই সাথে অবশ্যই অবকাঠামো ও শিক্ষকদের জীবনমান নিয়ে পরিকল্পনা করা উচিত এবং আমি আশা করি নীতি নির্ধারকরা তা নিয়ে ভাবছেন।
প্রিয় অভিভাবকদের বলবো- দুশ্চিন্তা না করে আপনার সন্তানের ওপর বিশ্বাস রাখুন, পাশে থাকুন। ওরা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি মেধাবী এবং সৃজনশীল। এগিয়ে যাওয়ার জন্য ওদের শুধু একটু উৎসাহ আর সহযোগিতা প্রয়োজন।
মজার ভিডিও বানিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করে, যাদের তলিয়ে দেখার মত সময় নেই বা যারা সুনির্দিষ্ট স্বার্থ হাসিলের জন্য পানি ঘোলা করতে চায় – আপনি কি তাদের দলে?
তাহলে মনে রাখুন, সেই ঘোলা পানিতে আপনার সন্তানকেও বসবাস করতে হবে।
স্রোতে গা ভাসানোর আগে অন্তত স্রোতটা ময়লা পানির কিনা তা যাচাই করুন প্লিজ….
শিক্ষক ও কলাম লেখক