স. ম. ইব্রাহীম »
দেশের আঞ্চলিক ইতিহাস নিয়ে যেসব গবেষক কাজ করেছেন, গবেষণা ভা-ার সমৃদ্ধ করেছেন তাদের মধ্যে আবদুল হক চৌধুরী উল্লেখযোগ্য। তিনি ১৯২২ সালের ২৪ আগস্ট রাউজান উপজেলার নোয়াজিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথিতযশা এ গবেষক চন্দ্রাবতী কাব্যের রচয়িতা কবি কোরেশী মাগন এর সপ্তম অধস্তন পুরুষ। তার পিতা শরফুদ্দিন ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার। তিনি রেঙ্গুন পোর্ট কমিশনে ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। আবদুল হক চৌধুরী তার পিতার প্রতিষ্ঠিত নোয়াজিশপুর স্কুলে ১৯৪২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন। চাকরি ছেড়ে ব্যবসাও করেন তিনি।
ছোটবেলা থেকে পুঁথি সংগ্রহে তার আগ্রহ ছিল। এখান থেকেই মূলত চট্টগ্রামের ইতিহাস নিয়ে তার আগ্রহ শুরু হয়। তার জন্মস্থান রাউজানের পার্শ্ববর্তী হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ইত্যাদি অঞ্চল নিয়েও তিনি গবেষণা করেন। চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তির সব উৎস তার লেখায় তুলে ধরেন।
প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ শিক্ষা না থাকলেও বাংলাদেশের আঞ্চলিক ইতিহাসচর্চায় তিনি যে অবদান রেখেছেন তা রীতিমত বিস্ময়কর। রাউজান হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক শশীচন্দ্র চৌধুরীর প্রেরণায় তিনি প্রথম আঞ্চলিক ইতিহাস সম্পর্কে উৎসাহিত হন। এ বিষয়ে তিনি আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ থেকেও অনুপ্রেরণা লাভ করেন। তারপর নিজ অঞ্চলের নশরত শাহের কতোয়ালির ধ্বংসাবশেষ, ঈশা খার দীঘি, আরাকানি দুর্গকোট এবং প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বিভিন্ন পুরাকীর্তি তাকে এ সম্পর্কে আরও কৌতূহলী করে তোলে। তিনি একসময় চট্টগ্রাম, সিলেট আরাকান ও ত্রিপুরার সামাজিক ও নৃতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহ শুরু করেন এবং তার ভিত্তিতে উক্ত অঞ্চলের ইতিহাস রচনায় ব্রতী হন।
একনাগাড়ে তিনি ১১টি গ্রন্থ ও বহু প্রবন্ধ রচনা করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে- চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ (১৯৭৬), চট্টগ্রামের চরিতাভিধান (১৯৭৯), সিলেটের ইতিহাস প্রসঙ্গ (১৯৮১), চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতির রূপরেখা (১৯৮৮), চট্টগ্রাম- আরাকান (১৯৮৯), প্রাচীন আরাকান রোহাইংগা হিন্দু ও বৌদ্ধ আদিবাসী (১৯৯৪) ইত্যাদি।
ইতিহাস চর্চার কারণে তিনি ‘চট্টলতত্ত্ববিদ’ নামে খ্যাত হন।
আবদুল হক চৌধুরী চট্টগ্রামের ইতিহাসচর্চায় অভূতপূর্ব অবদান রাখেন। তার রচনাবলী সমাজ ও সংস্কৃতির ইতিহাসচর্চায় নতুন পথচলার উপকরণ। তিনি চট্টগ্রামের ইতিহাস দর্শন রচনা করেছেন। তিনি একজন মৌলিক ইতিহাসবিদ।
একক প্রচেষ্টায় চট্টগ্রামবাসীর জন্য তিনি যা দিয়ে গেছেন তা কেবল আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের সঙ্গে তুলনীয়। চট্টগ্রামকে জানতে হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আবদুল হক চৌধুরীকে জানতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চ ডিগ্রি ছাড়া অথবা উচ্চতর গবেষণার প্রশিক্ষণ ছাড়া কেবল অধ্যবসায়, নিষ্ঠা, অনুসন্ধিৎসু মন ও অন্তর্চক্ষুর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি খ্যাতিমান গবেষক হতে পারে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত তিনি। তার গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র স্থানীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তিনি চট্টগ্রাম ও সিলেটের ইতিহাসের ওপর বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ রচনা করেন।
ইতিহাস গবেষণার আন্তর্জাতিক স্বীকৃত পদ্ধতি রয়েছে যার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সত্যে উপনীত হওয়া বা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছা। মৌলিক গবেষণার মূল উদ্দেশ্য সামনে রেখে তিনি আপন গবেষণা পদ্ধতির মাধ্যমে সত্যে উপনীত হবার প্রচেষ্টা করেছেন।
বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম তার পূর্ব প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ‘আবদুল হক চৌধুরী ও তার গবেষণা কর্ম’ শীর্ষক গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। ১৯৯৭ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমী থেকে সেটা প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, তার লেখা, প্রকাশিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ ড. আবদুল করিমের সংগ্রহশালায় ছিল, তাই তার সম্পর্কে গ্রন্থ প্রণয়ন করতে বেগ পেতে হয়নি। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ড. করিমকে তার গ্রন্থ প্রণয়ন করার জন্য অনুরোধ করেছিলেন।
তাঁর রচিত চট্টগ্রামের ইতিহাস প্রসঙ্গ (১ম ও ২য় খ-) এবং চট্টগ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি গ্রন্থ দুটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহায়ক গ্রন্থ হিসাবে পাঠ্যক্রমভুক্ত। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক নোয়াজিশপুরে স্মৃতিকেন্দ্র ও সংগ্রহশালা নির্মাণ করা হয়েছে।
আবদুল হক চৌধুরী স্বাধীনতা সংগ্রামের একজন সক্রিয় কর্মী। ১৯৭১ সালে রাউজান অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় প্রদান, খাদ্য ও অর্থ সহায়তা প্রদান ও প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকার কারণে তাকে এবং তার তৃতীয় পুত্রকে গ্রেফতার করা হয়। সেখানে হানাদার বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত হন। পরে জামিনে মুক্তি পান।
আবদুল হক চৌধুরী জীবদ্দশায় জাতীয় পুরস্কার না পেলেও ২০২১ সালে গবেষণার জন্য মরণোত্তর একুশে পদক পেয়েছেন।
গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৮৪ সালে নতুন সিংহ স্মৃতিপদকে এবং ১৯৮৭ সালে লেখিকা সংঘ পদকে ভূষিত হন।
এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদ পদক ও এক্স ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন পদক লাভ করেন। তাকে সংবর্ধনা দেয় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব, চট্টগ্রাম রোটারি ক্লাব, বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম সম্মিলিত ১লা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা পরিষদ, ঘাসফুলসহ অনেক সংগঠন।
তিনি চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘর ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য ছিলেন। রাউজান কু-েশ্বরী কলেজ পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গহিরা এ জে ওয়াই এম এস মাল্টিলেটারেল ইনস্টিটিউশনের সদস্য, নোয়াজিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি, বাংলাদেশ ফোকলার সোসাইটির কার্যকরী সদস্য, চট্টগ্রাম সংস্কৃতি পরিষদের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও রাউজান ক্লাবের উপদেষ্টা ছিলেন।
এ চট্টলতত্ত্ববিদ আঞ্চলিক গবেষণায় যে ভিত রচনা করেন তাতে নতুন গবেষকরা উপকৃত হবে, প্রেরণা পাবে। তাদের অনুসন্ধানী স্পৃহা বাড়বে।
তিনি ১৯৯৪ সালের ২৬ অক্টোবর পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে রেখে যান ৭ ছেলে ২ মেয়ে। তার সন্তানরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত।