খন রঞ্জন রায় »
অসুখ, রোগ নিরাময়, চিকিৎসাকৌশল, অস্ত্রোপচার, যন্ত্রপাতি উদ্ভাবন, টিকার ব্যবহার ইত্যাদি হাজার বছর ধরে ধাপে ধাপে উন্নয়ন ঘটেছে। ফলশ্রুতিতে চিকিৎসাবিজ্ঞান বর্তমান পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। নব নব উদ্ভাবন, নতুন গবেষণা ইত্যাদি চিকিৎসা ব্যবস্থাকে ক্রমাগত নিয়ে যাচ্ছে উৎকর্ষতার শিখরে। এসব অর্জন একদিনে হয়নি! লেগেছে হাজার হাজার বছর, বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রয়াস, শ্রমসাধ্য গবেষণা, মানবকল্যাণে কাজ করার অদম্য স্পৃহা তাঁদের কাজকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। এসবের পেছনে যাঁদের অবদান, তাঁরা নমস্য, প্রেরণার উৎস। মানবকল্যাণব্রতে নির্ভিক স্বপ্নযাত্রী।
সভ্যতার ইতিহাসে মানুষের পাঁচটি মৌলিক অধিকারের মধ্যে চিকিৎসাসেবা অন্যতম। মানব সভ্যতার প্রসারণে নানা কল্যাণের পাশাপাশি অনেক অকল্যাণও বাসা বাঁধছে জীবন-সংসারে। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে জীবনমান অটুট রাখতে চিকিৎসার কাছে অনেকটাই নির্ভরশীল। এই সময়ের কোভিড পরিস্থিতি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। অর্থ আছে- চিত্ত আছে, যন্ত্রপাতি আছে, জায়গা আছে হাসপাতাল বানানো যাচ্ছে না। সব আছের সাথে নাই কেবল দক্ষতা। নেই পর্যাপ্ত প্রশিক্ষিত জনবল।
স্বাধীন বাংলাদেশ চিকিৎসা শিক্ষার প্রসার ও মান উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি হয়। গত ৫০ বছরে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে ১০৭টি মেডিক্যাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সরকারি ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজে ৪ হাজার ২৩০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয় প্রতিবছর। আর ৭০টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয় সাড়ে ৮ হাজার জন।এছাড়াও দেশে দন্ত চিকিৎসা শিক্ষার ডেন্টাল কলেজও আছে ২৬টি। ৭০টি বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের মধ্যে কেবল ঢাকা বিভাগেই রয়েছে ৬০টি মেডিক্যাল কলেজ।
বর্তমানে দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৮ কোটি। এই বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্য বিভাগে ডাক্তারের পদ রয়েছে ২৪ হাজার ২৮টি। কর্মরত রয়েছেন ২২ হাজার ২৭৪ জন ডাক্তার। বিএমডিসি’র তথ্যানুযায়ী সরকারি ও বেসরকারি ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত ১:১৭২৪ জন। অর্থাৎ এক হাজার ৭২৪ জন মানুষের জন্য ডাক্তার রয়েছে মাত্র একজন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে চিকিৎসকের চাহিদাও ক্রমবর্ধমান। নানা হিসাব নিকাশ করে দেখানো হয়েছিল দেশে ১৬ কোটি মানুষের বিপরীতে ডাক্তারের চাহিদা ৬৩ হাজার ৩৯৫ জন। ২০২১ সালে ৬৭ হাজার ২৬৫ জন ছিল স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিবেচনায়। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় এই চাহিদা অনেক বেড়েছে। চাহিদা আর যোগান বা পর্যাপ্ততা নিশ্চিত না করার ফলে রোগিরা যথারীতি বেসরকারি ক্লিনিক হাসপাতালের দিকে ঝুঁকছে। অথবা বাধ্য হচ্ছে। হিসাবে দেখা গেছে চিকিৎসার খরচ মিটিয়ে বিপর্যস্ত হচ্ছে ১৫ শতাংশ মানুষ। গরিব হচ্ছে প্রতিবছর ৬৪ লাখ মানুষ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কঠোর আইনকানুন শর্ত নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে তোয়াক্কা না দেখিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার অবাধে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
“বিল্ডিং অ্যাওয়ারনেস অব ইউভার্সেল হেলথ কভারেজ বাংলাদেশ অ্যাডভান্স দি এজেন্ডা ফরওয়ার্ড” ২০১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যসেবা নিতে গিয়ে বাংলাদেশে জনপ্রতি পাবলিকের পকেট থেকে যায় চিকিৎসা ব্যয়ে ৬৯ দশমিক ৩ শতাংশ। যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, স্বাস্থ্যখাতে অর্থায়নের বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এ খাতে অপর্যাপ্ত ব্যয়, সরকারি ব্যয়ে নিয়ন্ত্রণহীনতা, বাজেটে কম বরাদ্দ, বরাদ্দ অনুযায়ী সঠিকভাবে বণ্টন না করা, নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি স্বাস্থ্য খাত, স্বাস্থ্যবীমায় অনীহা, দাতাগোষ্ঠীর সহায়তা কমে যাওয়া ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর স্বল্প অংশগ্রহণের কারণে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে। গবেষণায় প্রমাণিত স্বাস্থ্যসেবার ৬০ শতাংশ মানুষ পায় অসংগঠিত খাত থেকে। সরকারি খাত থেকে সেবা আসে ১৪ শতাংশ। আর বেসরকারি খাত থেকে মানুষ ২৬ শতাংশ সেবা পায়। এক্ষেত্রে চীন ও কিউবার মতো গুটি কয়েক দেশ ব্যতিক্রমী উদাহরণ। তাঁদের সরকার ব্যবস্থাও ভিন্ন ধাঁচের।
দেশের শিশুমৃত্যু হ্রাস, পুষ্টির উন্নতি, টিকাদানের হার বৃদ্ধিÑ স্বাস্থ্য খাতের এসব সাফল্যে বেসরকারি খাতের কোনো ভূমিকা ছিল না। অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণহীন বেসরকারি খাতের কারণে মানুষের স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় বাড়ছে। স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে দেশের বহু মানুষ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে এটি বড় ধরনের বাধা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবছর সাড়ে ৫২ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছে। বড় ধরনের আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে সোয়া দুই কোটি মানুষ। সর্বাধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা ও প্রাপ্তির নিশ্চয়তা প্রদান করতে না পারার কারণে প্রতিবছর বিপুল সংখ্যক লোক চিকিৎসার জন্য দেশের বাহিরে যেতে হয় বা যেতে হচ্ছে- যাচ্ছে। এই পরিস্থিতির অবসানে সংযুক্তি ঘটাতে হবে নিত্য নতুন সব প্রযুক্তি। সাথে প্রযুক্তিবিদ বা চিকিৎসা সহায়তাকর্মী। মূলত দুর্বলতা এখানেই। দেশের স্বাস্থ্য অবকাঠামোর সিংহভাগ শহরে অবস্থিত, অথচ মোট জনসংখ্যার সিংহভাগ গ্রামে থাকে- এ এক চরম বৈষম্য। স্বাস্থ্যসেবার বিকেন্দ্রীকরণ না করা গেলে চিকিৎসক ও রোগী- উভয়ের শহরমুখিতা বাড়বে। তাতে শহরের যানজট বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যসেবার অবনতি ছাড়া আর কিছু হবে না।
৭ এপ্রিল বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ লেটস বিল্ড আ ফেয়ারার, হেলদিয়ার ওয়ার্ল্ড ফর এভরিওয়ান (আসুন, সকলের জন্য অধিকতর ন্যায্য ও স্বাস্থ্যকর বিশ্ব গতে তুলি’)। কথাটি সাদামাটা কিন্তু ব্যঞ্জনাবহুল। এই প্রত্যাশার বাণীর নিরিখে যদি আমাদের স্বাস্থ্যসেবার দিকটি বিবেচনা করি তাহলে হতাশ হতে হয়। স্বাস্থ্য কেবল বায়োমেডিকেলের দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখে একে জনগণের অধিকার, ন্যায্যতা ও প্রাপ্যতার দৃষ্টিতে দেখতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে সব নাগরিকের জন্য বৈষম্যহীনভাবে স্বাস্থ্যসহ মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু বিপুল সংখ্যক জনগণ স্বাস্থ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশে স্বাস্থ্য অবকাঠামো গ্রামীণ পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে, এটি প্রশংসনীয় কিন্তু চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্টসহ প্রশিক্ষিত জনবলের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে, এবার করোনাকালে স্বাস্থ্যখাতে অনিয়ম, অদক্ষতা দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার নজির আমরা দেখেছি। স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদফতর ও স্বাস্থ্যের নানা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা প্রকটভাবে গণমাধ্যমে উদঘাটিত হয়েছে।
করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রচ- শক্তিশালী হয়ে যখন আঘাত হেনেছে তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অপ্রস্তুতভাবে তার মোকাবেলা করছে। মানুষ এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছুটোছুটি করছে স্বজনদের নিয়ে।
সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে জনগণের অংশগ্রহণ, সকল বিভাগের সমন্বয়, সুষম স্বাস্থ্য বণ্টন যার প্রয়োজন শহর থেকে গ্রামে, ব্যক্তিগত হতে সামাজিক, প্রতিরোধ হতে প্রতিরোধ পর্যায়, পরিবর্তনের স্বাস্থ্যকে উন্নয়নের উপর স্থান দেয়া- সেই সাথে উপযুক্ত কৌশল প্রণয়ন, গুণগত বিশ্লেষণ বাস্তবায়ন প্রয়োজন। সার্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা, সবার জন্য সর্বত্র নিশ্চিত করতে পৃথিবীর অনেক দেশ- ভার্চুয়াল ব্যবস্থাকে অনেক আগে থেকেই আত্মীকরণ করেছে। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা ও পরামর্শ প্রদান থেকে শুরু করে নানাভাবে জনস্বাস্থ্য হুমকি মোকাবিলা করছে। আমাদের চিকিৎসা শিক্ষাকে যদি উন্নত দেশের সমমানে উন্নীত করা যায়, তাহলে দেশের বিদেশি শিক্ষার্থীদের পড়তে আসা এবং দেশের চিকিৎসকদের বিদেশে চিকিৎসা দেওয়া সহজতর হবে। তবে দেশের মানুষের চাহিদা অপূর্ণ রেখে এসব ভাবা কোনোক্রমেই সমীচীন হবে না। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে বৈষম্যহীন জনমুখী রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল, সংবিধান অনুসারে প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের পবিত্র দায়িত্ব। সেই সেবা দিতে আমাদের একটি সময়োপযোগী স্বাস্থ্য মানবসম্পদনীতি প্রণয়ন আবশ্যক। যে নীতি আদর্শ গ্রহণপূর্বক স্বাস্থ্য কাঠামোর বিবেচনা করে সর্বক্ষেত্রে, সবার জন্য সঠিক পরিমাণে সঠিক গুণগত মানের স্বাস্থ্য ও জনশক্তি গড়ে তুলবে।
স্বাস্থ্যসেবার অব্যবস্থা কাটাতে বাজেটে অধিক বরাদ্দ চাই, দেশে জনসংখ্যা যেমন অধিক তেমনি সংক্রামক-অসংক্রামক রোগের প্রাদুর্ভাবও ঘটে চলেছে ব্যাপক। সুতরাং কেবল মহামারির সময় নয় বরং সকল সময়ের জন্য আমাদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা চাই। প্রয়োজন দক্ষ ও প্রশিক্ষিত জনবল, চিকিৎসক সংকট মেটাতে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির সংখ্যা বাড়াতে হবে। এবার করোনাকালীন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা জনগণের সেবায় অগ্রভাগে ছিলেন। অনেক চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী চিকিৎসা দিতে গিয়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের আত্মদান আমরা যেন ভুলে না যাই। আমাদের স্বাস্থ্যসেবার বেহল অবস্থার মধ্যে তাঁরা মহৎ মানবিকতার দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
আমরা মনে করি স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের অধিকারের দৃষ্টিতে দেখার পাশাপাশি যদি সামাজিক বিজ্ঞান হিসেবে বিবেচনা করি এবং স্বাস্থ্যসেবায় জনগণের সুযোগ, প্রাপ্যতা ও ন্যায্যতাকে সকলের ওপরে স্থান দিই, তবেই পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে।
সমাজচিন্তক, গবেষক ও সংগঠক
শযধহধৎধহলধহৎড়ু@মসধরষ.পড়স