রায়হান আহমেদ তপাদার »
স্বাধীন বাংলাদেশের পাঁচ দশকের কাছাকাছি আমরা। এই স্বাধীনতা অসংখ্য জীবন, অঢেল রক্ত এবং আরও বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত। পাকিস্তানের মতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আঁতাত করে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অর্জিত তথাকথিত স্বাধীনতা নয়। রীতিমতো রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে কেনা স্বাধীনতা। আর এত যে ত্যাগ-তিতিক্ষা, তা হাতেগোনা কয়েকজনের নয়। কোটি কোটি দেশবাসী সবারই সম্মিলিত ত্যাগ ও লড়াইয়ের পটভূমিতেই দেশের স্বাধীনতা সূর্যের উদয় ঘটে। আজ সে ইতিহাসের অনেকটাই আমরা বিস্মৃতির অতলে ঠেলে দিয়েছি। অথচ ওই ইতিহাস বাঙালি জাতির জন্য কতই না গৌরবের, কতই না তাৎপর্যবাহী। সেই বিস্মৃতির মাশুলও জাতিকে কম দিতে হচ্ছে না। বাঙালি জাতির গর্বের, সম্মানের এবং শ্রদ্ধার দাবিদার যে কয়জন মহান নেতা তারা হলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদ। তাদের মতো নির্লোভ, নিঃস্বার্থ ও সংগ্রামী নেতৃত্ব আমাদের দেশের ইতিহাসে অত্যন্ত বিরল। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি শাসনের নিগড় থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মানচিত্রে আবির্ভূত হয় ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতা ঘোষণার ৫০ বছর পূর্ণ হবে আগামী ২১ সালের ২৬ মার্চে। সার্বিক বিবেচনায় যথেষ্ট এগিয়েছে বাংলাদেশ। তবে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি নিয়ে যদিও অনেক প্রশ্ন আসে, তারপরও আমি বলব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।
এমনকি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ও বিভিন্ন দিকে এগিয়ে যাওয়ার হার সত্যিই ঈর্ষণীয়। কিন্তু কিছু জায়গার সমস্যা থেকে আমরা বের হতে পারছি না। এ সমস্যাগুলো আমাদের অভ্যন্তরীণ। যেমন দুর্নীতি থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারছি না। মানুষ সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে হয়রানির শিকার হয়, শিক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক মানে পৌঁছাতে পারিনি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও নিয়ম-কানুনে পিছিয়ে, সঠিক নগরায়ণের ক্ষেত্রে আমাদের অপরিপক্বতা, শিল্প স্থাপনে কোনো নীতি আমরা এখনো দাঁড় করতে পারিনি, পরিবেশের উন্নয়নে কাজকে গতিশীল করতে না পারার কারণে টেকসই উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা আমাদের বেঁধে রেখেছে। স্বাধীনতার পর একটি দেশ দাঁড়াতে যে সময় লাগে, এখন সেই সময় হয়ে গেছে। কিছু কাজ যদি আরো স্বচ্ছতা ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে করা সম্ভব হয়, তবে দেশ এগিয়ে যাবে আরো গতিশীলভাবে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, শিক্ষাকে একটি মানে নিয়ে আসা, দুর্নীতি রোধ, নগরায়ণে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশের উন্নয়নের মাধ্যমে কৃষিকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় পরিচালনা। এ কাজগুলো আমাদের করতেই হবে সুন্দর একটি দেশের জন্য, স্বাধীনতার আসল স্বাদ প্রাপ্তির জন্য। ভুলে গেলে চলবে না, আমরা দুশো বছর ব্রিটিশদের অধীনে ছিলাম। আমরা ২৪ বছর পাকিস্তানিদের অধীনে ছিলাম। নয়মাস মুক্তিযুদ্ধ করেছি। ৩০ লক্ষ জীবন উৎসর্গ করেছি, দুই লক্ষ মা বোনের সম্ভ্রম দিয়েছি। আমরা আমাদের একটা রাষ্ট্রের মালিক হতে নির্যাতন ভোগ করেছি।
এমনকি আমরা আমাদের ভাগ্য নিজেদের মতো করে গড়ে তোলার সুযোগ সৃষ্টির জন্য আন্দোলন সংগ্রাম করেছি। নিজদেশে পরাধীন জীবন থেকে মুক্তি চেয়েছি। রাজনৈতিক স্বাধীনতা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সুশাসন ভিত্তিক সমাজ ও নিজ সংস্কৃতির সুস্থ বিকাশকে বাধাহীনভাবে অর্জনের জন্য, প্রাপ্তির জন্য আমাদের উদগ্র বাসনার একাগ্রতাই বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। আজ বাঙালি স্বাধীন। ব্রিটিশরা নেই, পাকিস্তানিরা নেই, জমিদাররা নেই। তাও দেশের প্রধান কবিকে আফসোস করতে দেখা যায় বর্ণিত কবিতায়। কারণ সার্বিক বিচারে স্বাধীনতার সুফল হিসেবে আমাদের একমাত্র অর্জন স্বজাতির শাসন।
সামনে আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছর উদযাপন করবো।কিন্তু সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলো এখনো সোনার হরিণের মতো অধরাই থেকে গেছে। স্বাধীনতার পরবর্তী প্রতিটা জাতীয় বাজেটে কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্য বিমোচনকে গুরুত্ব প্রদান করা হলেও উন্নতির লক্ষণ দেখা যায়নি। জনসংখ্যা বেড়েছে, বাজেটের আকার বেড়েছে, যেসব খাতের ব্যয় বরাদ্দ বাড়লে জনগণের মুক্তিতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হতো তার প্রতিটা খাতে শতাংশের হারে ব্যয় বৃদ্ধি তো ঘটেইনি বরং দিনে দিনে শতাংশ হারে কমে গিয়েছে। ফলে সাধারণ জনগণের মধ্যে জীবন সংগ্রামে পরাজিতবোধের লক্ষণ ফুটে উঠছে। রাজনৈতিক দলগুলো মানুষের মনে আপোষকামিতা সৃষ্টির পরিবেশ তৈরি করে সকলকে যে দিকে এগিয়ে যেতে বাধ্য করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধর্মনিরপেক্ষ একটা দেশের জন্য, সমতাভিত্তিক সমাজের জন্য, উদার গণতন্ত্রের জন্য, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য।
ভাবতে অবাক লাগে, বাংলাদেশে ছাত্র ও শিক্ষকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলগুলোর লেজুড় বৃত্তিধারী সংগঠন করার ফলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ব্যাপকতর হয়ে পড়ছে। এতে শিক্ষায় সেশনজট সৃষ্টি করছে, শিক্ষা আর সংস্কৃতি বোধকে জাগ্রত করছে না, ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত করে তুলছে না, দেশপ্রেমকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করাচ্ছে না। জাতীয় জীবনে শিক্ষার সুফল দ্রুত পৌঁছে দিতে শিক্ষানীতির বাস্তবায়ন করা, বৈশ্বিকভাবে বর্তমানের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার প্রসার ঘটানো, মানবসম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা করে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো, সংবিধান অনুযায়ী বহুধারার সব শিক্ষাব্যবস্থাকে দেশপ্রেমমূলক বাঙালি জাতীয়তাবোধ সম্পন্ন একই ধারার শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন, যোগ্যতার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ, জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করে কর্মদক্ষতা অর্জন ও সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করার মতো ক্ষমতা লাভের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক দলের ভালো অঙ্গীকারগুলো সরল বিশ্বাসে গ্রহণ করতে দ্বিধা করে না। যদিও সহজে কোনোকিছু পাওয়া যায় না, কষ্ট করে অর্জন করতে হয়। কিন্তু আমাদের আকাক্সক্ষায় কষ্টসহিষ্ণুতার প্রবণতা কম। একশ্রেণির মানুষ ধনী হওয়ার প্রতিযোগিতায় নীতি-নৈতিকতাকে পাশে রেখে ছুটে চলেছে। আর একশ্রেণির মানুষ জীবনসংগ্রামে পরাজিত হয়ে সর্বস্ব হারিয়ে নগরমুখী হচ্ছে। বেকারত্ব আর দারিদ্র্যে সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির পথ হারিয়ে ফেলেছে। মানব সভ্যতার কৃষি যুগ থেকে শিল্পযুগ হয়ে এখন ডিজিটাল যুগ। তাই অগ্রসরমান বিশ্বের যুগোপযোগী কর্মসূচির দিকে নজর দিতে হবে।
বাংলাদেশে গত পঞ্চাশ বছরে আর্থিক ক্ষেত্রে অগগ্রতি চলমান। উনিশশো একাত্তর সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত, সাহায্যনির্ভর, ঋণনির্ভর স্বাধীন দেশটি আর্থিক উপার্জনের কৌশল বাড়িয়ে আজ মধ্যম আয়ের দেশের কাতারে। কৃষিভিত্তিক বাংলাদেশ জাতীয় আয়ের প্রধান উৎসকে কৃষি থেকে তৈরি পোশাক আর জনশক্তিতে রূপান্তর ঘটিয়ে ব্যাপক উন্নয়নের দ্বার খুলেছে। উনিশশো একাত্তর সালের মাথাপিছু আয় ৬৭১ টাকা আজ বেড়ে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ টাকার উপরে। এবং তখনকার সময়ে দেশের বার্ষিক রপ্তানিকেও বাড়িয়ে আকাশছোঁয়া করেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা ও সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। এত অগ্রগতির মধ্যে আর্থিক বৈষম্য প্রবল থেকে প্রবলতর হয়েছে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কল্যাণে আমদানি নীতি উদার হয়েছে, ফলশ্রুতিতে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের পাশাপাশি বৃহৎ শিল্পও হুমকির মুখে পড়েছে। ঋণখেলাপির সংস্কৃতির সাথে অবাধ সম্পদ ও কালো টাকা অর্জনের প্রতিযোগিতায় নৈরাজ্য বেড়েছে।
সাধারণ মানুষ ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে এবং গার্মেন্টস শিল্পনির্ভর কর্মসংস্থানের মধ্যেই জীবন সংগ্রামে নিবেদিত। এর সাথে সরকারের পক্ষ থেকে ৫০০ টাকার সামাজিক নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে অক্সিজেন সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। অবস্থা উত্তরণে মধ্যস্বত্বভোগীদের হাত থেকে গ্রামীণ অর্থনীতিকে রক্ষা, নারীপুরুষের মজুরি বৈষম্য নিরসন করা, আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে রফতানি বাড়ানো, দেশজ শিল্পকে সমৃদ্ধ করা, কৃষির আধুনিকায়ন ও বিজ্ঞাননির্ভর সংস্কার করা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।
এছাড়া সম্পদের অসম বণ্টন রোধ করা, ব্যাংকিং খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে জালিয়াতি বন্ধ করা, বিনিয়োগ ক্ষেত্রে প্রসার ঘটিয়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম জোরদার করা, মানবসম্পদ পরিকল্পনা করে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা, পরিবেশ দূষণ রোধের উদ্যোগ নেয়া জরুরি। যা অর্থনীতির প্রবাহকে গতিশীল এবং কর্মমুখী মানুষের ¯্রােতকে বেগবান করবে।
বর্তমানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ জাতীয় অস্তিত্বের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া বেকারত্ব ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের জন্য জনসংখ্যার পরিকল্পনা অত্যন্ত সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। অপরদিকে কাজের সুযোগ বাড়ানোর জন্য শিল্প-কারখানার প্রসার ও কৃষির বহুমুখীকরণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
জনসংখ্যা এবং নানা অবকাঠামো নির্মাণকল্পে প্রয়োজনীয় জমির স্বল্পতা অপর এক দুস্তর বাধা। এই বাধা দূরীকরণে জমির ব্যবহার বিশেষত কৃষিজমি অন্য কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ করে তা কার্যকর করা এবং অপরাপর জমিও সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য নীতিমালা প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। এতকিছুর অভাব সত্ত্বেও জাতীয় আয়ের যে অগ্রগতি বা তার হার দেখানো হয় তা বিস্ময়কর। কিন্তু পূর্বোক্ত চাহিদাগুলো পূরণ করলে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে আমাদের খুব বেশি সময় লাগার কোনো সঙ্গত কারণ নেই। এর সঙ্গে যদি আমাদের তেল, গ্যাস, কয়লা প্রভৃতি লুকায়িত সম্পদ আহরণ করতে এবং তার ব্যবহার সম্ভব হলে পরবর্তী আর একটি দশকের মধ্যে উন্নত দেশের পর্যায়ে চলে যাওয়াও বোধ করি সম্ভব। আর এগুলো নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অবশ্য প্রয়োজন।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
ৎধরযধহ৫৬৭@ুধযড়ড়.পড়স
























































