শওকত এয়াকুব
তুহিন মারওয়া সদ্য এইসএসসি শেষ করেছে। এখনো রেজাল্ট প্রকাশিত হয়নি। পরীক্ষার অনেক আগে থেকেই তার বিয়ের প্রস্তাব আসছে। অনেকটা পরিবারের সাথে যুদ্ধ করে পরীক্ষাটা দিয়েছে। তার স্বপ্ন ছিল বড় অফিসার হওয়ার। এখন সেই স্বপ্ন অংকুরেই বিনষ্ট হতে যাচ্ছে। আগামী মাসেই তার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হয়েছে। পাত্র সৌদিপ্রবাসী। মক্কায় বোরকার দোকান আছে, টাকা-পয়সার কোন কমতি নেই। কোন প্রকার দাবি-দাওয়াও নেই। মোহরানার প্রশ্ন উঠলে ছেলের বাবা বলে, মাপযন্ত্রের এক পাশে মেয়ে রাখবে অন্য পাশে মোহরানার টাকা দেবে। অর্থাৎ মেয়ের ওজন যত হবে মোহরানাও তত হবে। তবুও কথাবার্তা বলে বিশ লক্ষ টাকা মোহরানা ধার্য করা হলো। মেয়ে বিয়ে দেওয়ার সময় অনেক কিছু দেখে-শুনে বিয়ে দিতে হয় এবং এটাই উচিত।কারণ একটি মেয়ে সারাজীবন একটি নতুন পরিবেশে গিয়ে কাটাবে। তাই পাত্রের পরিবার সম্বন্ধে খোঁজখবর নিল মারওয়ার বাবা। জানা গেল পাত্রের পবিবারের একমাত্র ছেলে আবদুল হাকিম। তিন বোন, সকলের বিয়ে হয়েছে। বাড়িতে শুধু দুজন। বৃদ্ধ মা-বাবা। তুহিনের বাবা এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলেন না।তুহিনের আরও দুই ছোটবোন আছে। পরিবারে তার বাবাই একমাত্র অর্থ উপার্জনকারী ব্যক্তি। পাত্রপক্ষের কোন প্রকার দাবি-দাওয়া নেই। যদিওবা সমাজে নানান নিময় প্রচলিত আছে। কিন্তু এসব বাদ দিয়েই যখন বিয়ে হচ্ছে তাই তুহিনের বাবা বিয়েতে একটু বেশিই আগ্রহী। মানুষের বানানো নিয়মে একটি মেয়ে বিয়ে দিতে গেলে অন্তত পক্ষে চার-পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ। তার ওপর কত দাবি-দাওয়া, বিয়ের দিন পান থেকে চুন খসলে সর্বনাশ। আবার বিয়ের পর কত কিছুই যে করতে হয় তার কোন হিসেব নেই। কিন্তু পাত্রপক্ষের এত সব দাবি-দাওয়াও নেই। তাই তুহিনের মা এবং আত্মীয়রা তার পিতার আর্থিক অবস্থা, সামনে ছোটবোনদের বিয়েÑ এসব নানান কিছু বলে-বুঝিয়ে তাকে বিয়ের জন্য রাজি করালো।
নির্দিষ্ট তারিখে খুব আড়ম্বরের সাথে বিয়ে হয়। বিয়ের পর সব ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু সমস্যা শুরু হয় ছেলে কর্মস্থলে যাওয়ার কিছুদিন পর।
পাত্র আবদুল হাকিম সৌদি আরব চলে যাওয়ার সময় মারওয়াকেও কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। মারওয়া বাবার বাড়ি যাওয়ার সময় বিয়েতে পাত্রের পক্ষ থেকে দেয়া পনেরো ভরি গহনাও নিয়ে যায়। এতে কারো কোন আপত্তিও ছিল না। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি ফিরে আসার সময় কিছু গহনা বাবার বাড়িতে রেখে আসে। শুধু কানের দুল, নাকের নথ, গলার চেইন এবং হাতের চুড়িগুলোই নিয়ে আসে। কিছুদিন পর পাত্র আবদুল হাকিম মায়ের কাছে ফোন দিয়ে স্ত্রীর গহনাগাটিগুলো নিয়ে সামলিয়ে রাখতে বলে। কারণ হলো, আবদুল হাকিমের সাথে সৌদি-আরবে একই বাসায় থাকতো এমন দু-তিনজনও বিয়ে করেছে দেশে এসে। সবাই নিজেদের আনন্দময় মুহূর্তগুলো একজন আরেকজনকে জনকে বলেছে। এমন সময় কথা ওঠে গহনাগাটি নিয়ে। তারা বলে, তাদের স্ত্রীর গহনাগাটি মায়ের হাতে গচ্ছিত রেখে এসেছে। কিন্তু মারওয়ার পাত্র আবদুল হাকিম তো তাকেই দিয়ে গেছে। সবাই আবদুল হাকিমকে তার স্ত্রীর থেকে গহনাগুলো নিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দেয়। সেও তাদের কথা মতো তাই করতে বললো তার মাকে। আবদুল হাকিমের মা অর্থাৎ মারওয়ার শাশুড়ি তার থেকে গহনাগুলো চাইলে সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ওঠে। সে এ মুহূর্তে কি করবে বুঝতে পারছিল মা। শাশুড়ি কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর মারওয়ার রুম থেকে কোন কিছু না বলে পাকঘরে চলে আসে। রাগে মুখ লাল হয়ে আছে। মনে মনে কি যেনন বিড়বিড় করছে। এতক্ষণে মারওয়া তার মাকে ফোন দিয়ে গহনাগুলো তার বাবার মাধ্যমে পাঠাতে বলে। কিন্তু তার বাবা বাড়িতে ছিল না।তিনি শহরে গেছেন জমির মামলার কাজে। রাতে না ফেরার কথা ছিল। কিন্তু এ খবর শুনবার পর রাত গভীর হলেও ফিরে আসতে হবে। মারওয়া তার শাশুড়িকে সবিস্তারে বুঝিয়ে বলে। কিন্তু উনি এসব বুঝার চেষ্টাই করছেন না। উনার এক কথা। আমার ছেলে তোমাকে গহনা দিছে ব্যবহার করার জন্য। ব্যবহার না করলে ওই গহনা আমার বাড়িতেই থাকবে। কিন্তু বাবার বাড়ি কেন রেখে আসলে। এ নিয়ে নানান কথা বলে যাচ্ছে মারওয়ার শাশুড়ি : ‘আমার ছেলেকে ফকির করার জন্য মা-মেয়ে ইচ্ছা করে এমন করেছে’, ‘গহনাগুলো হজম করার জন্য ঐখানে রেখে এসেছে’, আরও কত কি। পরদিন মারওয়ার বাবা এসে বেয়াইনকে সব বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলে। মন বুঝতে না চাইলেও গহনাগুলো নেওয়ার জন্য বোঝার মিথ্যা অভিনয় করে।
এরপর অনেকদিন অতিবাহিত হয়ে গেল। ইতিপূর্বে যে সমস্যা হয়েছে তা প্রায় ভুলেই গেছে সবাই। তবুও মারওয়ার শাশুড়ি মাঝেমধ্যে খোঁচা মেরে কথা বলত। এর মধ্য নতুন করে আরেক সমস্যা সৃষ্টি হয়। সৌদি সরকার সকল প্রকার দোকানে টেক্স বৃদ্ধি করে এবং নতুনভাবে লাইসেন্স করার নির্দেশ দেয়। এখন আবদুল হাকিমকে তার দোকানের নতুন লাইসেন্স করতে হচ্ছে। না হয় দোকানে বন্ধ করে দিচ্ছে। আবদুল হাকিম যে মালিকের অধীনে দোকান নিয়েছে ওনিও কোন প্রকার সহযোগিতা না করে সব তার ওপর চাপিয়ে দেয়। আবদুল হাকিমের পক্ষে অধিক টেক্স প্রদান এবং নতুন লাইসেন্স করা সম্ভব না হওয়ায় বোরকার দোকানটি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
এরপর এমন একটি কাজে যোগদান করে যা তার পক্ষে করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। সেখানে প্রতিদিন ষোলো ঘণ্টা কাজ করতে হতো। যার ফলে শারীরিকভাবে সে অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। বাড়িতে এসব জানালে সবাই দেশে চলে আসতে বলে। সেও কোন উপায় না দেখে দেশে চলে আসে।
দেশে এসে কিছুদিন যেতে না যেতে শুরু হয় নতুন সংকট। দেশে আসার সময় যে টাকা-পয়সা নিয়ে এসেছিল এবং ব্যাংকে যা জমা আছে তা ছয়-সাত মাসের মধ্য শেষ হয়ে যায়। আবদুল হাকিমেরও নতুন কিছু করার ইচ্ছে নেই। বাড়িতে বসে বসে বেকার দিনাতিপাত করছে। উদ্যমী ছেলেটি এখন কেমন যেন হয়ে গেছে। এসবের জন্য আবদুল হাকিমের মা মারওয়াকেই দোষারোপ করে, গালমন্দ করে। তাকে এ বাড়িতে বউ করে আনার পর থেকে যে অপয়া লেগেই আছে। বাড়ির সুখ-শান্তি কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে। আশপাশের বাড়িঘরগুলোতে ছেলের বউ আনার পর তাদের বাড়িতে সুখ-শান্তি নেমে এসেছে, আয়-উন্নতি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাড়িতে সব সময় ঝগড়া লেগেই থাকে। আবদুল হাকিমের মা সব হারিয়ে এখন বাড়ি-বাড়ি দুঃখ বলে বেড়াই। তার সব সুখ-শান্তি এখন অতীত।