স্কুলে স্কুলে ভর্তি ফি বাণিজ্য

ফাইল ছবি

মনিটরিং টিমের খোঁজ নেই

নিলা চাকমা »

কমল ও প্রাপ্তি (ছদ্মনাম) দম্পতি। প্রাপ্তি বাসায় সেলাইয়ের কাজ এবং কমল বেসরকারি একটি এনজিওতে কর্মরত আছেন। তাদের দুটো সন্তানের মধ্যে বড় মেয়ে সুযোগ পেয়েছে (লটারিতে) বাংলাদেশ মহিলা সমিতি গার্লস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে (বাওয়া)।

নগরের স্বনামধন্য স্কুলে মেয়ের নাম দেখতে পেয়ে বেশ খুশি হয়েছিলেন তারা। কিন্ত সে খুশি ভর্তির বিজ্ঞপ্তি পেয়ে হারিয়ে যায়। বিজ্ঞপ্তিতে দেখতে পান – ভর্তি ফি ৫ হাজার টাকা, উন্নয়ন ফি ২ হাজার টাকা, সেশন ফি ৩ হাজার টাকা এবং জানুয়ারি মাসের বেতন ১ হাজার টাকা। সর্বমোট ১১ হাজার টাকা দিয়ে মেয়েকে প্রেপ-ওয়ান (শিশু ওয়ান) ভর্তি করানো হয়। বেতনের ৪০ শতাংশ ভর্তির পেছনেই চলে যায় বলে দাবি করেন কমল।
তিনি বলেন, মেয়ের ভালো স্কুলে নাম এসেছে। ভর্তি না করিয়ে কি পারা যায়। শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। তার পেছনে যদি এত টাকা চলে যায়। তাহলে নাওয়া খাওয়া বাদ দিতে হবে। এ ব্যাপারে কারও যেন মাথাব্যথা নেই।

ভর্তির অতিরিক্ত ফি আদায়ের প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি গার্লস হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের (বাওয়া) প্রধান শিক্ষক মো. আরিফ- আল হাসানকে ফোন দেওয়া হয়। কিন্ত প্রসঙ্গটি তোলার সাথে সাথে ব্যস্ততা দেখিয়ে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে ফোন দেওয়া হলে তিনি আর কল রিসিভ করেননি।

শুধু বাওয়া স্কুল নয়, চট্টগ্রামের আরও কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি বিজ্ঞপ্তি হাতে এসেছে। এরমধ্যে সেন্ট জোসেফ’স টিউটোরিয়াল স্কুলে ৬ হাজার ২০০ টাকা, অংকুর সোসাইটি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে (১-৫ম শ্রেণির জন্য) ভর্তি ফি ৫ হাজার ৮৫০ টাকা এবং খাতা ও ডায়রিতে ৯৩০ টাকা। (ষষ্ঠ-৯ম শ্রেণিতে) ভর্তি ফি ৫ হাজার ৮০০ টাকা এবং খাতা ও ডায়রিতে ১ হাজার ২০ টাকা। সেন্ট মেরিস স্কুলে ভর্তি ফি ৩ হাজার এবং নতুন ভবন নির্মাণে ১ হাজার টাকা। এ জি চার্জ স্কুলে ভর্তি ফি ৬ হাজার ৫০০ টাকা, ড্রেসে আরও ১ হাজার ২০০ টাকা কথা উল্লেখ রয়েছে।

কিন্তু বেসরকারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ (মাধ্যমিক, নিম্ন মাধ্যমিক ও সংযুক্ত প্রাথমিক স্তর) শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা -২০২২ এর ১০ দশমিক ৪ অনুচ্ছেদে বলা আছে- সেশন চার্জসহ ভর্তি ফি সর্বসাকুল্যে মফস্বল এলাকায় পাঁচশ টাকা, পৌর উপজেলা এলাকায় এক হাজার টাকা, পৌর (জেলা সদর) এলাকায় দুই হাজার টাকা, ঢাকা ব্যতীত অন্যান্য মেট্রোপলিটন এলাকায় তিন হাজার টাকার বেশি হবে না। কিন্তু সরেজমিন দেখা যায়, চট্টগ্রামের বেশির ভাগ স্কুল এ নীতিমালা মানেনি। বাড়তি ফি আদায় করেই ভর্তি করাচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এ নিয়ে প্রশাসনের দাপ্তরিক একটি কমিটি করা হলেও নজরদারি নেই ।

জানা যায়, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ভর্তির ক্ষেত্রে ভর্তি ফি বেশি নেওয়ার অভিযোগ পাওয়ায় মনিটরিং টিম গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৪ জন উপ-সচিবের নেতৃত্বে পৃথক ৪টি মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়। ভর্তি নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তি, ভর্তি ফি, উন্নয়ন ফিসহ অন্যান্য ফি প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যথাযথভাবে গ্রহণ করছে কিনা তা সরেজমিনে যাচাইয়ের জন্য বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিদর্শন করবে এসব কমিটি। ঢাকা মহানগরীর ১৬টি মনিটরিং কমিটি, ৮টি বিভাগীয় মনিটরিং কমিটি, ৫৫টি জেলা মনিটরিং কমিটি জেলা সদরের এবং উপজেলা মনিটরিং কমিটি উপজেলার সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উল্লিখিত বিষয়ে সরেজমিনে মনিটরিং করে মাউশি অধিদপ্তরে রিপোর্ট দেওয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মাধ্যমিক জেলা শিক্ষা অফিসার ফরিদুল আলম হোসাইনী সুপ্রভাতকে বলেন, ‘চট্টগ্রামেও কমিটি গঠন করা হয়েছে। কারা কারা কমিটিতে আছেন তা ওয়েব সাইটে গেলে দেখতে পাবেন। আমরা কারিকুলাম ও বই নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছি। আমরা পরে কাজ শুরু করবো। চলতি মাসের ৩১ তারিখের আগে পারা সম্ভব নয়।’
সদ্য মনিটরিং কমিটি কি স্কুলে পরিদর্শন করছে কিনা এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘পরিদর্শনের সঙ্গে যারা জড়িত আছি তাদের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ এবং বই নিয়ে ব্যস্ততা রয়েছে। যার ফলে পরিদর্শন করা হচ্ছে না। তবে আমরা মনিটরিং করছি।’

এরমধ্যে বেশ কিছু বেসরকারি স্কুলে ভর্তি কার্যক্রম প্রায় শেষ। তারা অতিরিক্ত ফি আদায় করেই ভর্তি নিচ্ছে শিক্ষার্থীদের। ভর্তির পরে পরিদর্শন করে কী লাভ হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অসুবিধা নেই। আমরা তো স্কুল থেকে রির্পোট নিব, সেটা জমা দেবো। যা পদক্ষেপ নেওয়ার তা নিবে মন্ত্রণালয়।’

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের শিক্ষা শাখার দায়িত্বশীল সিনিয়র সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট মিল্টন বিশ্বাস এ বিষয়ে এখনও কিছু জানেন না উল্লেখ করে বলেন, ‘মনিটরিং কমিটি সম্ভবত সম্প্রতি করা হয়েছে। বিষয়টি আমাদের কাছে আসেনি। মাধ্যমিক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয় (মাওশি) থেকে সরাসরি বলতে পারবে। তবে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি বাড়তি ভর্তি ফি আদায়ের অভিযোগ করে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবো।’
এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েসন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেইন বলেন, ‘শিক্ষা কখনোই ব্যয় বহুল হতে পারে না। সবার জন্য শিক্ষা। সব শ্রেণির নাগালে থাকতে হবে। তা না হলে সমাজের একটি শ্রেণি শিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে। তা হতে দেওয়া যাবে না।’

চট্টগ্রামে ভর্তি বাণিজ্য ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের অবস্থা জানিয়ে কথা হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বিভাগের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়েরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম নয়, পুরো বাংলাদেশে মনিটরিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় কাজও শুরু করে দিয়েছেন কর্মকর্তারা। শিক্ষাগ্রহণ করা সবার অধিকার। সরকার এ ব্যাপারে সচেষ্ট রয়েছে। আমরাও আমাদের যা করণীয় তাই করছি। কেউ যদি দায়িত্বে অবহেলা করে, তাহলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ বিষয়টি আমি কর্তৃপক্ষ বরাবরে জানাবো।’