সুচরিত চৌধুরী : একজন নিভৃতচারী কথাসাহিত্যিক

সনেট দেব »

বাংলা কথাসাহিত্যের আকাশে কিছু নক্ষত্রই চিরকাল আলো ছড়ায়। সুচরিত চৌধুরী সেই রকম একজন নিভৃতচারী, যিনি কলমে এবং সৃষ্টিতে জীবনের ক্ষুদ্রতম অনুভূতিকে তুলেছেন কাব্যিক মাত্রায়। চট্টগ্রামের বোয়ালখালীর এক সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া এই শিল্পীর জীবন বহুমাত্রিক; যেখানে সাহিত্য, সংগীত এবং বাঁশির সুর একত্রিত হয়ে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য শিল্পপরিমণ্ডল। ছোটবেলায় তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতি তেমন আগ্রহী ছিলেন না, কিন্তু বাবার সাংস্কৃতিক প্রভাব এবং পারিবারিক সাহিত্যচর্চা তাঁকে সাহিত্যিক মননের দিকে টেনে নিল। গল্প, কবিতা, গান—এই তিন ভুবনেই তিনি নিজেকে নিমগ্ন রাখতেন।
সুচরিত চৌধুরীর শৈশবের কথা বললে বোঝা যায় যে, তাঁর মনের গভীরে মানুষের জীবনের প্রতি গভীর সহমর্মিতা জন্ম নিয়েছিল। পিতার সঙ্গে পুঁথিসাহিত্যের তথ্য সংগ্রহে তিনি ছোটবেলায় অংশ নিতেন। স্কুলজীবন সাধারণ মানের, এমনকি কখনও কখনও সীমাবদ্ধতামূলক হলেও, তিনি তাঁর সহপাঠীদের মধ্যেই প্রকৃত বন্ধু খুঁজে পেতেন। সেই বন্ধুত্ব এবং সহমর্মিতা তার পরবর্তী লেখনীর মূল শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। বাঁশি বাজানো, সংগীত চর্চা এবং সাহিত্য—এই তিনটি ছিল তাঁর আবেগের কেন্দ্রবিন্দু। স্কুলে তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনোভাবের মানুষ ছিলেন; নিয়মতান্ত্রিকতা এবং কৃত্রিমতা তাকে বিরক্ত করত। এভাবেই তিনি নিজেকে স্বাধীনভাবে সৃজনশীলতায় নিমগ্ন রাখতেন।
তাঁর কর্মজীবনও ছিল বহুমাত্রিক। করাচি থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক দিগন্ত-এর সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক রেনেসাঁ, মাসিক উদয়ন ও মাসিক সীমান্ত-এর সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্ক ছিল। প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই তিনি চট্টগ্রাম বেতারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন এবং বাঁশির সুরে শ্রোতাদের মন জয় করেছেন। তবে সবকিছু মিলিয়ে তিনি ছিলেন কথাশিল্পী হিসেবেই সবচেয়ে বেশি স্বীকৃত। ‘শুধু চৌধুরী’, ‘সুরাইয়া চৌধুরী’ এবং ‘চলন্তিকা রায়’—এই ছদ্মনামগুলোতে তিনি তাঁর লেখার বিভিন্ন দিক প্রকাশ করেছিলেন। ‘শুধু’ তাঁর ডাকনাম, যা তাঁর স্বকীয় সৃজনশীলতা ও পরিচয়ের সঙ্গে যুক্ত।
সাহিত্যকীর্তির মধ্যে তাঁর গল্প এবং কবিতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আকাশে অনেক ঘুড়ি, একদিন একরাত, নদী নির্জন নীল, সুরাইয়া চৌধুরীর শুধু গল্প, সুচরিত চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ গল্প, সুচরিত চৌধুরীর নির্বাচিত গল্প এবং কিংবদন্তীর গল্প: চট্টগ্রাম—এই গ্রন্থগুলোতে তিনি সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন, আনন্দ-বেদনা, প্রেম, দ্রোহ এবং আর্তিকে প্রাণবন্তভাবে উপস্থাপন করেছেন। শিশুতোষ গল্প আকাশে অনেক ঘুড়িুতে ঘুড়ির চরিত্রের মাধ্যমে তিনি বন্ধুত্ব, সহমর্মিতা এবং মানবিক মূল্যবোধ ফুটিয়ে তুলেছেন। অন্য গল্প যেমন চুড়ি বা স্বাতীর চিঠিুতে রহস্য, জটিল সম্পর্ক এবং মনস্তাত্ত্বিক সূক্ষ্মতা লক্ষ্য করা যায়। টুল-বেঞ্চের দিনগুলিুতে তিনি স্কুলজীবনের নস্টালজিক স্মৃতি এবং পাঠকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে বুনেছেন, যার ফলে গল্পটি প্রায় উপন্যাসের আকার ধারণ করেছে।
ষাটের দশকের চট্টগ্রাম, যখন শহরটি তখনও একটি মফস্বল শহর, তখন সাহিত্যিক পরিবেশ ছিল সীমিত কিন্তু প্রাণবন্ত। আন্দরকিল্লা, লালদিঘি, টেরিবাজার—এই এলাকায় শহরের প্রাণচাঞ্চল্য ফুটে উঠত। রিক্সা, টমটম, গরু-ঘোড়ার গাড়ি এবং সীমিত সংখ্যক মোটরযান চলাচল করলেও মানুষের মধ্যে এক নিভৃত শান্তি এবং আন্তরিক মানবিকতা বিরাজ করত। এই পরিবেশে সুচরিত চৌধুরীর সাহিত্য জন্ম নিল, যা স্থানীয় জীবনের বাস্তবতা ও মানবিকতা সমৃদ্ধ।
সুচরিত চৌধুরীর সাহিত্যকীর্তি কেবল সমকালীন পাঠককে প্রভাবিত করেনি; আজও তা সমকালীন এবং পরবর্তী প্রজন্মের পাঠকদের মনে গভীর ছাপ রাখে। তাঁর লেখা সহজ অথচ প্রাঞ্জল ভাষা, চরিত্রের জীবন্ত উপস্থাপন এবং মানুষের গভীর অনুভূতির বর্ণনা তাকে সমকালীন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্রে পরিণত করেছে। ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার অর্জন তাঁর সাহিত্যকীর্তির স্বীকৃতি।
১৯৯৪ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি প্রয়াত হন, কিন্তু তাঁর সাহিত্য, গান এবং গল্পের সৃষ্টিশীলতা চিরকাল জীবন্ত থেকে যাবে। পাঠক তাঁর গল্পের মাধ্যমে আজও অনুভব করতে পারে মানবিক সংযোগ, সাধারণ মানুষের জীবন ও অনুভূতির গভীরতা। আধুনিক বিশ্বে যখন প্রযুক্তি এবং দ্রুতগতি সাহিত্যিক এবং সাংস্কৃতিক মঞ্চ পরিবর্তন করছে, তখন সুচরিত চৌধুরীর লেখা আমাদের মনে করিয়ে দেয় মানবিক সংযোগ, সহমর্মিতা এবং জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুহূর্তের সৌন্দর্য কত মূল্যবান।
সুচরিত চৌধুরী ছিলেন নিভৃতচারী শিল্পী, যিনি তাঁর কলম, বাঁশি এবং সৃষ্টিশীল মন দিয়ে জীবনকে অনন্যভাবে অনুভব করেছেন। তাঁর গল্প, কবিতা এবং সঙ্গীত আমাদের শেখায়—সৃজনশীলতা শুধু চিরস্থায়ী নয়, তা মানুষের হৃদয়ে ছাপ রেখে যায়। তিনি প্রমাণ করেছেন যে, নিভৃত, সংযমী এবং নিমগ্ন শিল্পীর জীবনই চিরকালীন সৃষ্টিশীলতার মাধুর্য সৃষ্টি করে। চট্টগ্রামের সাহিত্য-সংস্কৃতির এই উজ্জ্বল নক্ষত্র আজও আমাদের সাহিত্যিক চিন্তাভাবনা ও মানবিক মূল্যবোধকে আলোকিত করে।