সফিক চৌধুরী »
নানা অনিশ্চয়তা আর জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে আজ অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। বিগত বছর করোনা মহামারি’র কারণে সঠিক সময়ে অনুষ্ঠিত হতে না পারা এই নির্বাচন আমাদের কাছে আশা এবং একই সাথে কিছুটা শঙ্কাও জাগিয়েছে। কারণ, নির্বাচন পূর্ববর্তী সংঘাতে প্রাণহানির ঘটনাও ঘটেছে, যা সাধারণ ভোটার ও নাগরিক সমাজকে কিছুটা হলেও শঙ্কায় ফেলেছে। সাধারণ ভোটার আর নাগরিক সমাজের এই উদ্বেগ আর শঙ্কা দূর করার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশন আর তাঁদের অধীন সম্মিলিত প্রশাসন আর সরকারের। আজকের নির্বাচনে যে দলের প্রার্থীই জয়ী হউক না কেন, আসল জয় হবে নির্বাচন কমিশনের যদি তাঁরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে সমর্থ হয়। সার্বিক বিচারে সুষ্ঠু ও অবাধ সিটি নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশন কতটা সদিচ্ছা আর সামর্থের পরিচয় দিতে পারছে- এই নির্বাচনে তা প্রমাণিত হবে।
জমা দেওয়া বৈধ মনোনয়নপত্র অনুযায়ী চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী রয়েছেন সাতজন। অন্যদিকে ৪১টি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে ১৭৩ জন এবং সংরক্ষিত ১৪টি ওয়ার্ডে ৫৭ জন নারী প্রার্থী রয়েছেন, যদিও ১৮ নম্বর বাকলিয়া ওয়ার্ডে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন। এছাড়া ৩১ নম্বর আলকরন ওয়ার্ডের একজন কাউন্সিলর প্রার্থী মারা যাওয়ায় সেখানকার কাউন্সিলর নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে।
আজকের চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, প্রথাগত ব্যালট পেপারে সিল মারার ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এবারই প্রথম আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ইভিএমে সব কেন্দ্রে ভোট হতে যাচ্ছে। আমাদের সাধারণ ভোটার যাঁরা ঐতিহ্যগতভাবে স্বতঃপ্রণোদিতভাবে ভোটের উৎসবে যোগ দিতে আনন্দ অনুভব করেন, তাঁরা নতুন প্রযুক্তি ইভিএমে ভোট দিতে কেন্দ্রে আবারও সেই উৎসবের আমেজেই হাজির হবেন, এমনটাই আশা নির্বাচন কমিশনের, কমিশনের সেই আশা কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা দেখার অপেক্ষায় অনেকেই।
নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে একজন মেয়র প্রার্থী নির্বাচনে কারচুপি হলে আন্দোলনের হুমকি দিয়েছেন, এমন কিছু হলে আন্দোলন কতটা হবে বা আদৌ হবে কিনা সে আলোচনাকে এক পাশে রেখে, এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের যথার্থ জবাব হতে পারে নির্বাচনটি অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা। আমরা আশা করি, এ ব্যাপারে সব রাজনৈতিক দল দলীয় সংকীর্ণতাকে পিছনে ফেলে নির্বাচন কমিশনকে ঐকান্তিকভাবে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন। বিশেষ করে, ক্ষমতাসীনদের এমন কিছু করা উচিত হবে না, যাতে প্রতিপক্ষ অভিযোগ করার সুযোগ পায়।
যে কোন জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রার্থীদের কাছ থেকে তাঁরা নির্বাচিত হলে কী করবেন তার একটি ঘোষণা পাই, যাকে আমরা ইশতেহার বলেই জানি। এবারও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মেয়র পদপ্রার্থীদের কাছ থেকে এমন ইশতেহার আমরা পেয়েছি। কিন্তু, সেগুলো কতটা বাস্তবায়নযোগ্য আর বাস্তবতার নিরিখে প্রকাশ করা হয়, তা একটি প্রশ্ন বটে। দেখা যায়, ইশতেহারে যে সমস্যাগুলো সমাধানের কথা বলা হয়, তা আদতে মেয়রের এখতিয়ারেই নেই, তাহলে যা তাঁর এখতিয়ারে বা অধীনেই নেই তা তিনি সমাধান করবেন কিভাবে? এসব ইশতেহারের অধিকাংশই করপোরেশনের আর্থিক সামর্থ, প্রশাসনিক সক্ষমতা, আইনগত এখতিয়ার, করপোরেশনের জনবল ইত্যাদি বিবেচনা না করেই পেশ করা হয়। তাই, এমন অতি স্বাপ্নিক ইশতেহারগুলো অনেক ক্ষেত্রে নিরর্থক বলেই মনে হয়।
সেদিন বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী’র ইশতেহার দেখছিলাম, সেখানে তিনি ৯টি প্রধান পয়েন্টের অধীনে ৭৪টি প্রতিশ্রুতি যুক্ত করেছেন। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ৩৭ দফা নির্বাচনী ইশতেহার পেশ করেছেন। দুটো ইশতেহারের মৌলিক বক্তব্য অনেকটাই কাছাকাছি। জনগণ যা চায়, দেখা যাচ্ছে আমাদের নগর পিতা হতে ইচ্ছুক প্রার্থীদেরও একই চাওয়া। তাহলে, প্রশ্ন এসে যায়, নির্বাচন পরবর্তীতে ইশতেহারগুলোর বেশিরভাগই পূরণ হতে না পারার দায় কার? প্রধানত, আমাদের নগরে সেবা সংস্থাগুলোর পারস্পরিক সমন্বয়হীনতাই এক্ষেত্রে দায়ী। নগরপিতা জলাবদ্ধতা দূর করতে চান, জনগণও চায় এর থেকে মুক্তি। কিন্তু সিডিএ বা ওয়াসা কোন কাজে কর্পোরেশনের সাথে সমন্বয় না করলে তা আদৌ দূর হওয়ার নয়। নগরবাসী যানজট থেকে মুক্তি চান, দুই প্রধান দলের মেয়র পদপ্রার্থী এটাকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইশতেহার পেশ করেছেন, কিন্তু পুলিশ প্রশাসনের সাথে সমন্বয় না হলে তা সমাধান হবে কিভাবে? নগরীতে গাড়ির লাইসেন্স প্রদান করার এখতিয়ার বিআরটিএ’র, কিন্তু তাদের সাথে সিটি করপোরেশনের কোন সমন্বয় নেই, আর এভাবেই চলছে।
আমাদের ভাবনার সময় এসেছে, যে উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও মহান চেতনায় এবং বঙ্গবন্ধু’র দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বে আমরা পেয়েছি আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ, স্বাধীনতা’র ৫০ বছরের প্রাক্কালে আমরা তা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি? একটা শহরে শুধু কিছু পাকা রাস্তা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, উঁচু দালান, কিছু শপিং মল, অল্পবিস্তর ব্যবসা-বাণিজ্য আর প্রধান সমুদ্র বন্দর থাকলেই যে সে নগর সত্যিকারের নগরী হয়ে উঠে না বা উঠতে পারে না, তাঁর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আমাদের এই প্রিয় চট্রগ্রাম। আমরা চট্টগ্রামকে বলি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নগরী, কিন্তু এখনও আমরা এ নগরীতে একটি আন্তর্জাতিকমানের সম্মেলন কেন্দ্র গড়ে তুলতে পারি নাই বা বলা যায় গড়ে তোলা হয় নাই। নভোথিয়েটার সহ নাগরিকের চিত্ত বিনোদনের অনেক কিছুই এখানে নেই। নগরীতে যেভাবে মূল সড়কে দ্রুতগতির যান্ত্রিক যানের পাশে ধীর গতির রিকশা চলাচল করে তাতে এ নগরীকে বাণিজ্যিক রাজধানী ডাকা অনেকটা কৌতুকপূর্ণ বলেই মনে হয় যদিও উন্নয়নের প্রথম শর্ত, সুন্দর ও শৃঙ্খলাপূর্ণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। আর আমরাও চাই, আমাদের নগরীর যোগাযোগ ব্যবস্থা হবে বিশ্বমানের। পরিকল্পিত নগরীর কথা আমরা বলি, কিন্তু সেইমতো পরিকল্পনা কী আমরা করি? চট্টগ্রামে এখন অনেকগুলো উড়ালসড়ক, যদিও সেগুলো প্রায়শই থাকে ফাঁকা! আমরা কী একবারও ভেবে দেখেছি, কেন উড়াল সড়কের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না? আমাদের অনেকগুলো রাস্তাকেই যানজট এড়াতে মোড়গুলো বন্ধ করে একমুখী করা হয়েছে, কিন্তু পথচলতি মানুষের রাস্তা পারাপারে কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি! তাতে পথচলতি মানুষজন বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে এলোপাথাড়ি রাস্তা পার হতে গিয়ে যানজটের সৃষ্টি করছেন, দুর্ঘটনায় পড়ছেন।
কিন্তু, এভাবে আর কতদিন? রাস্তার এই অনাচারের দায়ভার কার? নাগরিকের জন্য পরিকল্পিত নগরী গড়বে কে? আশা করি, আমাদের ভবিষ্যত নগর পিতা এগুলো সমাধানে সচেষ্ট হবেন এবং নাগরিক সমাজসহ সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।
যাই হউক, নির্বাচন কমিশনের অগ্নিপরীক্ষা আজ। ভোটারদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারার সামর্থ ও যোগ্যতার পরীক্ষা এটি। ইতিমধ্যে প্রাণহানি সহ বেশ কিছু অঘটনের ঘটনাও ঘটেছে, যা কোনভাবেই কাক্সিক্ষত ছিল না। দিনশেষে, সব উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে পিছনে ফেলে জয় হউক গণতন্ত্রের, উন্নয়ন ঘটুক নগরের।
লেখক : বিতার্কিক
নড়ষড়ংযধভরয়ঁব@মসধরষ.পড়স