হুমাইরা তাজরিন »
সিনেমার গান বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশের সিনেমায় গান একটি অন্যতম অনুষঙ্গ। প্রতিটি সিনেমার সাফল্যের পেছনে গানের বিশেষ ভূমিকা থাকে। এ বছরের ঈদুল আযহায় মুক্তি পাওয়া হিমেল আশরাফের পরিচালনায় শাকিব খান ও ইধিকা পাল অভিনীত চলচ্চিত্র ‘প্রিয়তমা’র টাইটেল সঙ্গীত এবং চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত শবনব বুবলি ও মাহফুজ আহমেদ অভিনীত ‘প্রহেলিকা’ সিনেমায় ‘মেঘের নৌকা’ ও ‘হৃদয় দিয়ে’ শিরোনামের গানগুলো লিখেছেন গীতিকবি আসিফ ইকবাল। তাঁর লেখা গানগুলো ইতোমধ্যে দর্শকদের কাছে পেয়েছে ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
‘আমি খুঁজেছি তোমায় মাগো, আমি খুঁজেছি তোমায়’Ñ ২০০৬ সালে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠিত ক্লোজআপ ওয়ান নামের গানের রিয়েলিটি শোতে প্রতিযোগী রাশেদের কণ্ঠে গানটি শুনে বিচারকসহ কেঁেদছিলেন লাখ লাখ দর্শক-শ্রোতা। শওকত আলী ইমনের সুরে গানটির কথা লিখে সেই সময় আলোচনায় আসেন আসিফ ইকবাল। শুধু তাই নয়, একই শোয়ের টাইটেল ট্র্যাক ‘যদি লক্ষ্য থাকে অটুট, বিশ্বাস হৃদয়ে, হবেই হবে দেখা, দেখা হবে বিজয়ে’ গানটিও তাঁরই লেখা। হিমছড়ির বাঁকে জন্ম নেওয়া আসিফ ইকবালের লেখা জেমসের কণ্ঠে ‘দুরন্ত মেয়ে’ গানটা বাংলা গানে অনবদ্য সংযোজন। তারও আগে বহু জনপ্রিয় গান তিনি রচনা করেছেন বাংলাদেশের অন্যতম সেরা কণ্ঠশিল্পীদের জন্য। যার মধ্যে আছেন নকীব খান, বাপ্পা মজুমদার, পার্থ বড়–য়া, শাকিলা জাফর, কনক চাঁপা, ফাহমিদা নবী, ন্যান্সি, কনা, মাহাদী, এলিটা, রিংকু, নিশিতা বড়–য়া, পারভেজ, রন্টি, শফিক তুহিন, বালাম, সাব্বির ও এহসান রাহী।
সম্প্রতি সুপ্রভাতের সাথে নিজের গানগুলো নিয়ে কথা বলেন আসিফ ইকবাল।
সুপ্রভাত: দীর্ঘকাল ধরে নির্মাতাদের নির্ভরতার নাম আসিফ ইকবাল, কীভাবে?
আসিফ ইকবাল: গানের প্রতি নিষ্ঠার কারণে। গানকে ভালোবাসি। গানের মাধ্যমে মানুষের প্রাণ স্পর্শ করা আমাকে আলোড়িত করে। সেই কারণে রয়ে গেছি।
সুপ্রভাত: নির্ভরতাটা কেমন উপভোগ করেন?
আসিফ ইকবাল: দেখুন, আমি যত না উপভোগ করি তার চেয়ে বেশি বিনয় অবনত থাকি। কারণ হচ্ছে এর পরের কাজটা আমি ঠিকঠাক মতো করতে পারবো কিনা আমি জানি না। পরের কাজটা তো এগুলোকে ছাড়িয়ে যেতে হবে। ছাড়িয়ে যেন যায় তার জন্য যে প্রস্তুতিটা- সেটা আমি নিতে পারবো তো? এই ভয়, শংকা আমার মধ্যে কাজ করে। আমার ৪০ বছরের ক্যারিয়ারে আমার কাছে কখনও মনে হয়নি যে আমি অনেক কিছু করে ফেলেছি। আমি মনে করি, আমার সবসময় মাটির কাছাকাছি থাকতে হবে, বিনয় থাকতে হবে আমার মধ্যে, দর্শকদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে হবে এবং সৃষ্টিকর্তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকতে হবে।
সুপ্রভাত: গানের মাধ্যমে কীভাবে গল্পকে ধারণ করেন?
আসিফ ইকবাল: চিত্রনাট্যই হচ্ছে সিনেমার মূল বিষয়। চিত্রনাট্যকে বোঝার চেষ্টা করি, যারা অভিনয় করছে তাদের বোঝার চেষ্টা করি, তারা চরিত্রকে গানের মাধ্যমে কিভাবে প্রাণস্পর্শী করবে সেটা দেখার চেষ্টা করি, পরিচালকের চাহিদা কী সেটা বোঝার চেষ্টা করি। এটা আসলে তৎক্ষণাৎ একটা নিজের মতো করে গান লিখে ফেললাম এমন না। আমার কাজ হচ্ছে, গানটার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া। প্রস্তুতিটা হলো- চিত্রনাট্যটি বার বার পড়া। প্রিয়তমার চিত্রনাট্যটি বোধহয় আমি ১৪ বারেরও বেশি পড়েছি। কেননা গানের মাধ্যমে গল্পকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব থাকে। প্রহেলিকার ‘মেঘের নৌকা’ যখন আমি করি, আমি জানি যে ওখানে একটা বদ্ধ জায়গা আছে এবং ওরা একটা বদ্ধ জায়গার মধ্যে দমবন্ধ অবস্থায় আছে সেখানে তাদের ভালোবাসার জায়গাটা একটা কল্পনায় রূপ নেবে, সুতরাং সেটা হতে হবে বিস্তুৃত। তাই মেঘের নৌকাটাই যথাযথ উপমা ব্যবহার করেছি। আবার ‘আমিতো নিজেই এসেছি যেঁচে’ এই যে গানটা ‘হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে যারা’ সেখানে অনেক জটিল একটা পরিস্থিতি, দুজনের অপ্রাপ্তি নানা রকমের টানাপোড়েন এই সমস্ত কিছুকে মিলিয়ে গানটা লিখেছি। সেজন্যেই ‘হৃদয় দিয়ে ভালোবাসে যারা, ভালোবেসে মরে যায় তারা’ এই ধরনের লাইনগুলো ব্যবহার করেছি।
সুপ্রভাত: শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করার মন্ত্র আয়ত্ব করলেন কীভাবে?
আসিফ ইকবাল: যে গল্প দিয়ে আমি দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয় স্পর্শ করতে চাই সেই গল্পটাকে বোঝা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয়ত, যেহেতু আমি মার্কেটিংয়ের লোক সেহেতু মানুষের সাথে আমার সংম্পৃক্ততা অনেক বেশি। মানুষের সাথে মেশার অনেক চর্চা আছে আমার। আমি মানুষের সাথে আন্তরিকভাবে মিশতে পছন্দ করি, তাদের আবেগ-অনুভূতিগুলোকে বোঝার চেষ্টা করি। সেটাই আমার গানে রূপান্তরিত হয় এবং দর্শক-শ্রোতা সংযোগ অনুভব করে।
সুপ্রভাত: ঢাকায় চট্টগ্রামের শিল্পীদের কাজ করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা কেমন?
আসিফ ইকবাল: দেখতে হবে আমার চেষ্টার চাইতে প্রতিবন্ধকতা জোর বেশি কিনা। আমি মার্কেটিংয়ে থেকে লেখালেখি চালিয়ে গেছি। আমি চেয়েছি বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে। চট্টগ্রামের ছেলে-মেয়েরাই বাংলাদেশের সংগীতে রাজত্ব করছে। কুমার বিশ্বজিৎ, আইয়ুব বাচ্চু, নকীব খান, সোলস, ইমন সাহা উনারা সবাই চ্ট্টগ্রামের। এই যে কিশোর ছেলেটা যে ‘হৃদয় দিয়ে’ গানটা করেছে চট্টগ্রামের ছেলে। নদী-পাহাড়ে সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম। এখানকার ছেলেরা সৃজনশীলতা নিয়ে বড় হয়। চট্টগ্রামের ছেলে-মেয়েরা শিল্প-সাহিত্যে ভালো করবে এটা অবধারিত। আমাদের এখনকার গায়ক মিনার- কি অনবদ্য গান তাঁর। একটা নতুন ছেলে আসছে এম এ আলম শুভ নাম, অনেক জনপ্রিয় হয়েছে সে। তারপরে আবরার শাহিন নামে একটা ছেলে আছে। এই ছেলেরা অনেক বেশি প্রতিশ্রুতিপূর্ণ। আমি চাই যে, আরো অনেকে উঠে আসুক।
সুপ্রভাত : সামনে আপনার কী কী কাজ থাকছে শ্রোতাদের জন্য?
আসিফ ইকবাল: সামনে একটা চলচ্চিত্র আসছে। কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে হাবিবুল ইসলাম হাবিবের পরিচালনায় আফজাল হোসেন এবং ভাবনা অভিনীত। চলচ্চিত্রটির নাম ‘যাপিত জীবন’। যার সবকটা গান আমি লিখছি।