নিজস্ব প্রতিবেদক »
মোহাম্মদ মিজান। নগরের স্টেশন রোডে দিন মজুরের কাজ করেন। সারাদিনের কর্মব্যস্ততা সেরে ইফতারের সময় ঘনিয়ে এলো। সিআরবি শিরিষতলা হয়ে হাঁটছিলেন। এসময় সুসজ্জিত টেবিলে ইফতারের আয়োজন দেখে থমকে দাঁড়ান। কিন্তু তার মত অচেনা লোক এ ইফতারের আয়োজনে বসতে পারবে কিনা সে সংশয়ে রয়েছেন। প্যান্ডেলের পাশে কিছুক্ষণ অপেক্ষাও করেন। লক্ষ্য করতে থাকেন কি হচ্ছে। দেখতে পেলেন তার মত অনেক মানুষ সুসজ্জিত এ টেবিলে বসছেন। নিঃসংশয়ে তিনিও প্যান্ডেলের দিকে এগোতে শুরু করলেন। এর পাশে যেতেই টেবিলে বসার জন্য আহ্বান জানান লাল জামাপরা এক লোক। রোজা মুখে এমন সম্মান দেখে তিনি আবেগে আপ্লুত। বসে পড়েন আরো অনেকের মতন। একই টেবিলে অনেক অচেনা মুখের সাথে ইফতার করে হাত তুলে প্রার্থনা করেন।
আমি অবাক হয়েছি যখন আমাকে ইফতার গ্রহণের আমন্ত্রণ জানানো হলো- বলেন মোহাম্মদ মিজান। তিনি সুপ্রভাতকে বলেন, ‘ইফতারের সময় ঘনিয়ে আসায় সিআরবি এলাকায় একটু বিশ্রাম করে টাইগারপাসের দিকে যেতাম। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে এখানে টাকা ছাড়াই সম্মানের সাথে ইফতার করতে পেরেছি। এ ইফতার আয়োজনে যারা কাজ করছেন, যারা অর্থ প্রদান করছেন সকলের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেছি। তাদের এ আয়োজন যেন আরও বৃহৎ হতে পারে। আমার মত আরও দুস্থ মানুষ যেন এমন সহায়তা পায়।’
পথশিশু সোহেল বলেন, ‘ইফতারের সময় বেশিরভাগ মানুষ বাসায় ইফতার করেন। কিন্তু কেউ এনে দিলে আমরা ইফতার করি। তাও ইফতারের পরে। এখানের বড় ভাই-বোনগুলো খুব আন্তরিকতার সাথে আমাদের ইফতার করায়। ইফতারের সময়ই ইফতার করায়। রোজা রাখি বা না রাখি তারপরও ইফতার করায়।’
গতকাল সোমবার সরেজমিনে নগরের সিআরবি শিরিষতলা এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে এমন চিত্র। সুসজ্জিত প্যান্ডেলে করা হয়েছে ইফতারের ব্যবস্থা। এ আয়োজনের কাজ করছে সর্বজন খ্যাত বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। ‘সবাই মিলে বাংলাদেশ’ স্লোগানে দুস্থ খেটে খাওয়া মানুষের জন্য করা হয়েছে এ আয়োজন। রমজান মাসজুড়ে এ আয়োজনে ইফতারের ব্যবস্থা থাকছে।
সোমবার দুপুরে দেখা গেছে, দশ থেকে বার জন লাল পোশাক পরা স্বেচ্ছাসেবক ইফতার তৈরিতে কাজ করছে। কেউ কাঁটছে আপেল, কেউবা বানাচ্ছে প্যাকেট। হাসিমুখে স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করছিলেন তারা। প্রতি প্যাকেটে দেওয়া হবে ছোলা, জিলাপি, আপেল, ডিম, পেঁয়াজু বেগুনি, খেজুর, বিস্কুট, মুড়িসহ শরবত ও পানি।
কাজের ফাঁকে কথা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবক মাংসাথোয়াই মারমা এর সাথে। তিনি বলেন, ‘বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের সাথে প্রায় ছয় বছর ধরে কাজ করছি। বিশ্ববিদ্যালয় হলে থাকলেও মহৎ এ কাজের জন্য ছুটে আসি সাধারণ মানুষের দ্বারপ্রান্তে। বিনা পারিশ্রমিকে শ্রম দিয়ে যে আনন্দ মনের মধ্যে সঞ্চার করে তা টাকা দিয়ে কেনার মত নয়। এখানে কাজ করতে আসলেই মনে হয় এটাই আমি। পৃথিবীতে এটাই আমাদের সর্বউৎকৃষ্ট কাজ।’
চট্টগ্রাম মহিলা পলিটেকনিক্যালের আর্কিটেকচার বিভাগের শিক্ষার্থী কেয়া বড়ুয়া বলেন, ‘রমজানের এসময় ঘরে বসে মোবাইলে বেকার সময় নষ্ট না করে বিদ্যানন্দের এ আয়োজনের সাথে যুক্ত হতে পেরে অন্যরকম সুখানুভূতি কাজ করছে। মানব সেবার এমন মহৎ কাজে সকলের সহযোগিতা ও অংশগ্রহণই পারে বাংলাদেশকে উন্নতির আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে নিতে।’
ইফতার আয়োজনের সমন্বয়ক মিজানুর রহমান বলেন, ‘মাস ব্যাপী চলবে আমাদের এ ইফতার আয়োজন। প্রতিদিন সাড়ে তিনশ’র বেশি মানুষকে ইফতার বিতরণ করা হবে। নগরের বাইরে বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে দেড়শ থেকে দুইশ জনকে ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে ইফতার। প্রথম রমজানে শিকলবাহা এলাকায় প্রায় দুইশ পরিবারকে ইফতারি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। আজও (সোমবার) শিকলবাহা কালারপোল এলাকায় ১৬০ জনকে ইফতারি পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। সিআরবি এলাকায়সহ চারশ জনকে ইফতার করানো হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘যে কেউ চাইলে আমাদের এ ইফতার আয়োজনে অংশগ্রহণ করতে পারে। কেউ যদি একদিনে একশ মানুষকে ইফতার করাতে চায় আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এ কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে।’