আহমেদ জুনাইদ, চবি »
দেশে তৃতীয় বারের মতো শুরু হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ’। এটি সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক বাংলাদেশের অন্যতম বড় টুর্নামেন্ট।
৯ সেপ্টেম্বর যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে আয়োজিত এই প্রতিযোগিতার উদ্বোধন করেন পরিকল্পনা মন্ত্রী এম এ মান্নান এমপি। এতে ১২৫টি বিশ্ববিদ্যালয় অংশগ্রহণ করলেও তেমন সাড়া নেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। ১২টি ইভেন্টের মধ্যে শুধু বাস্কেটবল টিম অংশগ্রহণ করেছে। তাও প্রথমে দল পাঠানোর ব্যাপারে চিন্তাভাবনা ছিলো না প্রশাসনের। পরে শিক্ষার্থীদের সমালোচনার মুখে বাধ্য হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি এতো বড় টুর্নামেন্ট, কিন্তু তাদের অংশগ্রহণের জন্য কোন চিঠিই দেওয়া হয়নি। তাছাড়া ছিলো বাজেটের স্বল্পতা।
অন্যদিকে প্রতিযোগিতার একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেন খোদ বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের টিম নেই কিন্তু উপাচার্য অতিথি,এই বিষয় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়েছে হাস্যরস। তাই চিঠি পায়নি সেই অভিযোগ ও মানতে নারাজ শিক্ষার্থীরা। আগেও এমন বিভিন্ন টুর্নামেন্টে প্রতিযোগীরা শিকার হয়েছেন প্রশাসনের গাফিলতির। তাদের দাবি টুর্নামেন্ট এর ব্যাপারে না জানলে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য কিভাবে সেখানে অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করে।
খোঁজ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরিক শিক্ষা ও ক্রীড়া বিজ্ঞান বিভাগ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে পাওয়া যায় অভিযোগের পাহাড়। তাদের সদিচ্ছার অভাবেই শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারছে না। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিভাগটিতে ক্রিকেট, ভলিবল, সাঁতার, ফুটবল ও অ্যাথলেট এর জন্য প্রশিক্ষক রয়েছে ৫ জন। হকি, টেবিল টেনিস, দাবা, সাইক্লিং ইত্যাদি ইভেন্টের জন্য নেই কোন প্রশিক্ষক। আবার ৫ জন প্রশিক্ষকদের কেউই নিয়মিত মাঠে সময় দেন না। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো মানের দল গঠনে নেই কোন প্রচেষ্টা। তাই ৩০,০০০ শিক্ষার্থী ও অবারিত মাঠ থাকলেও কোন ইভেন্টেই নেই শক্তিশালী দল। আর এজন্যই কোন টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণে আগ্রহ বোধ করে না বিশ্ববিদ্যালয়। তবে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন ইভেন্টে মাঝেমধ্যে ভালো ফলাফল আসে শিক্ষার্থীদের একক প্রচেষ্টায়।
এমনই একজন উবায়েদ আবদুল্লাহ আদিব। ২০১৯ বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিফে ১০০ মিটারে রৌপ্য পদক বিজয়ী। নিজ বিশ্ববিদ্যালয় কে প্রতিনিধিত্ব করে এনে দিয়েছেন জয়ের মুকুট। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে করা হয়নি কোন সহযোগিতা। আক্ষেপ করে তিনি বলেন, টুর্নামেন্টে অংশগ্রহণের জন্য শারীরিক শিক্ষা বিভাগের সাথে যোগাযোগ করি। তারা আমাকে জানায় তারা খেলোয়াড় পাঠাবে না।
খেলোয়াড়দের খরচও বহন করতে পারবে না। কারণ সেখানে খেলোয়াড় নেওয়া, থাকার ব্যবস্থা করা ইত্যাদির বাজেট তাদের হাতে নেই। পরে আমি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকজন অ্যাথলেট নিজ খরচে টুর্নামেন্টে অংশ নেই। প্রশাসন থেকে সাহায্য না পাওয়ায় সেখানে আমি মাত্র একটি ইভেন্টে অংশগ্রহণ করতে পারি। অথচ বিভাগ থেকে একটু যতœ পেলে ৮টা পদক নিয়ে আসতে পারতাম।
আদিব আরো জানান, ওনাদের গাফিলতির জন্য আমাদের শুধু পদক পেয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়, সার্টিফিকেট পাওয়া হয় না। বিশ্ববিদ্যালয় কে ৯টি পদক এনে দিয়েছি। কিন্তু সার্টিফিকেট পেয়েছি মাত্র ১টির। অথচ আমাদের সাথে অংশ নেওয়া অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সবাই সার্টিফিকেট পেয়ে গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য ভাল মানের খেলোয়াড় আছে। কিন্তু প্রশিক্ষকদের চরম অনীহার কারণে খেলোয়াড় বের হচ্ছে না। অনেক ক্রীড়াবিদ সঠিক যতেœর অভাবে হারিয়ে যায়। গতবারের বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় টুর্নামেন্টে আমরা ফুটবলের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করি। নিজেদের আগ্রহ এবং টানা অনুশীলন এর মাধ্যমে ভালো মানের দলই তৈরি হয়েছিলো। বাসের টিকেট ও কাটা ছিল আমাদের। হঠাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জানায় তারা ফুটবলে অংশগ্রহণ করবে না। কেন অংশ নেবে না তার কোন জবাব দেয় নি। সবগুলো খেলোয়াড়কে হতাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। এইবছরও একই পরিস্থিতি। বিভাগ থেকে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নেই। যোগাযোগ করার পর বলে বাজেট নেই। এভাবে চললে অদূর ভবিষ্যতে শারীরিক শিক্ষা বিভাগ শুধু নামেই বেঁচে থাকবে, ফলাফল আসবে না।
শারীরিক শিক্ষা বিভাগের উপ-পরিচালক ও ক্রিকেট প্রশিক্ষক সিরাজুদ্দীন মোহাম্মদ আলমগীর জানান, এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা বাজেটের। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জাতীয় ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে দুটি প্রতিযোগিতার বাজেট পাই। এর বাইরে অসংখ্য টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সেখানে খেলোয়াড় পাঠাতে হলে যে বরাদ্দ প্রয়োজন তা আমাদের নেই। এই টুর্নামেন্টে বাস্কেটবল টিম পাঠাচ্ছি সম্পূর্ণ নিজেদের অর্থায়নে।
মাঠে প্রশিক্ষকদের গাফিলতির ব্যাপারে তিনি জানান, এখানেও মূল সমস্যা অর্থের। যদি ৫০টা ছেলেকে প্রতিদিন ট্রেনিং করাতে চাই তাহলে কমপক্ষে ১০টা বলের প্রয়োজন। একটা বল কিনতে ৫০০ টাকা লাগে। একটা ব্যাট ৭ হাজার টাকা। এতো টাকা তো বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের দেয় না। তাও বিভিন্ন টুর্নামেন্টে আমরা নিজেরা খরচ করে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দেই।
বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবুল মনছুর জানান, এই টুর্নামেন্টের ব্যাপারে আমরা জানতাম না। আয়োজক কমিটি আমাদের ইনভাইটেশন কার্ড বা মেইল কিছুই দেয়নি। উপাচার্যের সাথে এ ব্যাপারে কথা বলেছি। তবে এরা মূলত বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজন করে কোটি টাকার ব্যবসা করে। তাই কারা অংশগ্রহণ করলো বা না করলো তা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই।
তবে চিঠি না পাঠানোর বিষয়টি অস্বীকার করে বঙ্গবন্ধু আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপের সিনিয়র এক্সিকিউটিভ শহীদুল হাসান বিলাস বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম থেকেই ঝামেলা করছে। মূলত তারা টুর্নামেন্টের ব্যাপারেই সিরিয়াস না। অফিসিয়ালি চিঠি পাঠানো হয়নি এটা ভুল। জুনের ৭ তারিখে মিডিয়ায় প্রচারের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন শুরু হয়। এরপর থেকেই কয়েকবার অফিসিয়ালি চিঠি, মেইল পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি ফোন দিয়েও জানানো হয়েছে। তারা টিমও রেজিস্ট্রেশন করেছিলো। কিন্তু কোনো ক্রীড়াবিদ দেয়নি।’
তিনি আরো বলেন, শেষদিকে তারা হঠাৎ ফোন দিয়ে বলেছে, বঙ্গবন্ধু ইন্ট্রা-ইউনিভার্সিটি স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপ হচ্ছে তারা নাকি জানেই না। তখন আমাদের উত্তর ছিল, যেখানে চিটাগং ইউনিভার্সিটির ভিসি এই চ্যাম্পিয়নশিপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে টুঙ্গিপাড়ায় গেলেন, আগের দিন পর্যন্ত সেখানে ছিলেন, মশাল প্রজ্বলন করলেন, অথচ আপনারা জানেন না, এটা কিভাবে সম্ভব?
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর ড. মনিরুল হক জানান, এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলতে পারবো না। তবে অর্থের জন্য ক্রীড়াবিদ তৈরি হচ্ছে না বা টুর্নামেন্টে অংশ নেয় না বিষয়টি ঠিক নয়। আমরা চেষ্টা করি শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সহায়তা করতে।