করোনা রোগীদের পাশে থাকছে স্বজনরা
# মৃতের গোসল ও দাফনে বাড়ছে স্বজনদের উপস্থিতি #
ভূঁইয়া নজরুল :
চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ৬৫ বছর বয়সী আবদুস শুক্কুরকে সেবা করছেন স্বজনরা। হাসপাতালে স্ত্রী, ছেলে ও ছেলের বউও রয়েছেন। রাউজানের নিবাসী আবদুস শুক্কুরের পুত্রবধূ তাবিহা সুলতানা রুম্পা বলেন, ‘শ্বাসকষ্ট ও হার্টের সমস্যা নিয়ে তিনদিন আগে মেডিক্যালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে ভর্তি করা হয়েছে। করোনার নমুনা দেয়া হয়েছে, এখনো রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। তবে শ^শুরের পাশে থেকে সেবা করতে পেরে শান্তি লাগছে।’ রুম্পার মতো এমন অনেক স্বজন নিজেদের আপনজনদের পাশে থেকে করোনা উপসর্গ নিয়ে কিংবা করোনা শনাক্তের রোগীদের পাশে থেকে সেবা দিচ্ছে। করোনার প্রথমে যা ছিল অকল্পনীয়।
একই কথা বলেন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের পক্ষে প্রথম থেকে করোনা রোগীদের সেবা দিয়ে আসা নাহিদ আলম। তিনি বলেন, ‘শুরুতে করোনা আক্রান্ত রোগীদের পাশে কেউ থাকতো না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলে গেছে। এখন রোগীর স্বজনরা পাশে থাকছে। শুধু পাশে থাকাই নয়, কেউ মারা গেলে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলোর সাথেও তারা থাকার চেষ্টা করছে। আবার কেউ কেউ গোসল ও দাফনের কাজটিও নিজেদের লোক দিয়ে করছে।’ রোগীদের পাশে থাকার এই চিত্র শুধু চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নয়, জেনারেল হাসপাতাল, মা ও শিশু হাসপাতালসহ অন্যান্য হাসপাতালেও একই চিত্র।
সাহসী হচ্ছে মানুষ
করোনা আক্রান্ত রোগীর পাশে প্রথম দিকে কেউ থাকতো না। হাসপাতালগুলোতে ভর্তি করার পর পরিবারের অন্য সদস্যদের অনেকে রোগীর খবরও নিতো না। এমনকি মারা যাওয়ার পরও প্রশাসন বা স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে দাফনের কার্যক্রম শেষ করতো। কিন্তু এখন সেই চিত্র অনেকটা বদলে এসেছে।
এবিষয়ে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্ব¡াবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, ‘মানুষ এখন সাহসী হয়ে উঠছে। আগে করোনা রোগীদের হাসপাতালে রেখে চলে যেত। কিন্তু এখন রোগীর পাশে থেকে সেবা দেয়ার চেস্টা করছে। এতে রোগী মানষিকভাবে চাঙ্গা থাকছে এবং সেবাও পাচ্ছে। ফলে দ্রুত সুস্থ হয়ে ফিরছে।’
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, আমাদের এখানে টেকনাফের এসিল্যান্ড ও উখিয়ার এক চিকিৎসক করোনায় ভর্তি হয়েছিলেন। তাদের পক্ষে কেউ খবরও নিতে আসেনি। পরে আমাদের লোক দিয়ে তাদের সার্ভিস দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে। তবে এখন আর সেই চিত্র নেই। রোগীর পাশে স্বজনরা থাকছে।
স্বজনরা থাকতে হাসপাতালগুলোর কোনো বিধিনিষেধ রয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, না, কোনো বিধিনিষেধ নেই। আমরা তো রোগী প্রতি নার্স বা ওয়ার্ডবয় নিশ্চিত করতে পারি না। তাই রোগীদের ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়া কিংবা কিছু লাগলে রোগীর স্বজনরা দিতে পারে। এতে রোগীর খুব সহায়ক হয়। তাই আমরা রোগীর স্বজনকে পাশে থাকতে দিচ্ছি।
এদিকে চট্টগ্রামে এপর্যন্ত ৩৫৪ লাশের গোসল ও দাফন কার্যক্রম সম্পন্ন করা গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশের লাশ দাফন কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মোসাহেব উদ্দিন বখতেয়ার বলেন, ‘এখন লাশকে কবরে নামানোর সময় আমাদের পাশে রোগীর স্বজনরা থাকার চেষ্টা করছে। একইসাথে গোসল করানোর সময়ও তারা আশেপাশে থাকছে। কিন্তু এপ্রিল, মে কিংবা জুনের শুরুতেও আমরা দেখতাম কেউ লাশের পাশে আসছে না। এখন সেই চিত্র নেই। মানুষের মধ্যে সাহস সঞ্চার হচ্ছে।’
মানুষের মধ্যে এই সাহস সঞ্চার হওয়াকে সাধুবাদ দিয়ে মৃতদেহের গোসল ও দাফন কার্যক্রম করা অপর স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা কোয়ান্টম ফাউন্ডেশনের প্রধান সমন্বয়ক কামরুল হাসান সবুজ বলেন, ‘স্বজনদের এই এগিয়ে আসা সমাজের জন্য খুব পজিটিভ এবং পারিবারিক বন্ধন মজবুত হচ্ছে। প্রথমদিকে মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক ছিল এখন আর সেই আতঙ্ক বা ভয় নেই।’
তিনি আরো বলেন, এখন লাশের গোসলের সময় গরম পানি লাগার কথা বলছে। একইসাথে ভালো করে গোসলের কথা বলে। আর অনেক বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছে। এখন মনে হচ্ছে আমরা আগের সেই মমতাময় সমাজের দিকে এগুচ্ছি।
প্রথম দিকে ছিল অজ্ঞতা
করোনারোগী মারা যাওয়ার তিন ঘণ্টা পর আর কোনো জীবাণু থাকে না। কিন্তু প্রথম দিকে মানুষের মধ্যে ভয় কাজ করতো, কারণ তারা এ তথ্য জানত না। প্রচারণাও হয়নি।
এখন মানুষ অনেক সচেতন আখ্যা দিয়ে জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্ব¡াবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ বলেন, ‘প্রথমদিকে তথ্যের সঠিক প্রচারনা হয়নি। মানুষ ধীরে ধীরে জানতে পেরেছে যে মৃতের তিন ঘণ্টা পর আর ভাইরাসের জীবানু থাকে না। একইসাথে সতর্কতার মাধ্যমে এই ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এতেই মানুষের ভয় কেটে যাচ্ছে।’
সাহসী হওয়ার ভয়ও আছে!
শুধু হাসপাতাল নয়, রাস্তাঘাটে মানুষের বিচরণ বেড়েছে। শপিংমল ও যানবাহনগুলোতে বেড়েছে মানুষের যাতায়াত। করোনা কিংবা করোনা উপসর্গ নিয়ে রোগীদের মারা যাওয়ার পর এখন আর দূরে ঠেলে দেয়া হচ্ছে না। কিন্তু এগিয়ে আসার মধ্যে একটা ভয়ও রয়েছে বলে জানান গাউসিয়া কমিটি লাশ দাফন কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়ক মোসাহেব উদ্দিন বখতেয়ার। তিনি বলেন, ‘সুরক্ষা ছাড়া মানুষ এগিয়ে এলে করোনা ছড়িয়ে পড়তে পারে। তাই এই এগিয়ে আসার মধ্যে ভয়ও আছে। মানুষকে সতর্ক হতে হবে।’
একই মন্তব্য করেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বী বলেন, ‘মানুষ আগের চেয়ে অনেক সাহসী হয়ে উঠছে সত্য। রাস্তাঘাটে মানুষের চলাফেরা যেমন বেড়েছে তেমনিভাবে করোনা রোগীদের সেবায় স্বজনরাও থাকছে। কিন্তু এভাবে সাহস কমে যাওয়ায় আগামীতে যাতে তা ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।’
আসন্ন কোরবানির ঈদ নিয়ে আমরা শঙ্কায় রয়েছি জানিয়ে সিভিল সার্জন সেখ ফজলে রাব্বী বলেন, ‘এখন চট্টগ্রামে করোনা আক্রান্তের হার কমলেও আসন্ন কোরবানির ঈদের পর তা বেড়ে যেতে পারে গরুর বাজার ও ঈদের কারণে এই ভয় কাজ করছে।’
উল্লেখ্য, সারাদেশে গত মার্চ থেকে শুরু হয় করোনাকাল। চট্টগ্রামে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় ৩ এপ্রিল। তখন করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা করতে স্বজনদের কেউ যেতো না। হাসপাতালগুলোতে আইসোলেশনে থাকতো রোগীরা। সম্পূর্ণএকা থাকায় মানসিকভাবে অনেক রোগী ভেঙ্গে পড়তো। এদিকে চট্টগ্রামে এপর্যন্ত করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ৪৭৭ জন এবং এদের মধ্যে মারা গেছেন ১৯৮ জন ও সুস্থ হয়ে বাড়ি গেছেন ১২৬৫ জন।