আনোয়ারুল ইসলাম »
১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। চারদিকে শুধু আতঙ্ক আর আতঙ্ক। পাকবাহিনীর অত্যাচারে গ্রাম থেকে পালিয়ে গেছে অনেকেই। কিন্তু ১৫ বছরের কিশোর রবি পালায়নি। সে অত্যন্ত দুরন্ত ও নির্ভীক। ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে শোনা পাকিস্তানের শোষণ ও নির্যাতনের কথা তাকে আগুনের মতো জ্বালিয়ে রেখেছিল।
একদিন সন্ধার পর পাশের বাড়িতে গোপন বৈঠক করতে এলেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধার দল।
রবি দূর থেকে সব দেখছিল। হঠাৎ সে এগিয়ে গিয়ে বলল, আমাকেও আপনাদের দলে নিন, আমিও যুদ্ধ করতে চাই।
রবির কথা শুনে সবাই অবাক। এইটুকু ছেলের কী সাহস! শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়বে। কিন্তু তার সাহস দেখে কমান্ডার রফিক তাকে গুপ্তচর ও বার্তাবাহক হিসেবে দলে নেয়। কারণ, কিশোরদের চলাফেরা সন্দেহজনক মনে হয় না।তাই শত্রুর খবর আনার কাজে সে ছিল সবচেয়ে সাহসী।
রবির প্রথম দায়িত্ব ছিল পীরগাছা বাজারের পাকসেনাদের ক্যাম্পের খবর সংগ্রহ করা।
বাবার পুরনো লুঙ্গি পরে, ছেঁড়া জামা গায়ে দিয়ে, গা -মাথায় কাদা মাটির প্রলেপ লাগিয়ে, সে যেন গ্রামের এক সাদাসিধে বালক। সেই সাজে সে ক্যাম্পের কাছে চলে যায়, সৈন্যর কথা শোনে, তাদের অস্ত্র পরিবহনের গাড়ি চিনে রাখে। ফেরার সময় পাকসেনাদের এক টহলদল তাকে থামায় এবং বলে- কোথায় যাচ্ছিস?”
রবি মাথা নিচু করে বলে, মায়ের জন্য দোকানে ওষুধ কিনতে গিয়েছিলাম।
পাকসেনারা মৃদু হেসে তাকে ছেড়ে দেয়।
আর সেই রাতেই রবি মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য -যুদ্ধের মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়ার মতো তথ্য।
পরদিন ভোরে মুক্তিযোদ্ধারা প্রস্তুত হয়। রবিও সঙ্গে থাকতে চায়। সবাই বাঁধা দিলে সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, যে দেশ আমাকে বড়ো করেছে, মায়ার আঁচলে আগলে রেখেছে, যার বুকে উৎপাদিত ফসল খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে, তাকে বাঁচানোর লড়াই থেকে আমাকে দূরে রাখবেন না।
যুদ্ধ শুরু হতেই আকাশ ফাটানো বন্দুকের গর্জনের শব্দে চারদিক কেঁপে উঠল। এতে রবি কোনোরকম ভয় পায়নি। আহত রফিক কমান্ডারের পাশে দাঁড়িয়ে সে গুলি ভরে দিচ্ছিল, সহযোদ্ধাদের পানি পৌঁছে দিচ্ছিল, আবার মাঝেমধ্যে শত্রুর অবস্থান জানিয়ে দিচ্ছিল। তার এমন সাহসিকতায় সেই দিন পাকবাহিনীর ওই ঘাঁটি পতন হয়।
যুদ্ধ শেষে গ্রামের মানুষ যখন মুক্ত আকাশ দেখল, তখন রবির চোখে জল। সে জানে-এই স্বাধীনতার জন্য তার অনেক ভাই-বোন, বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-পড়শি জীবন দিয়েছেন। তারা আর কোনদিন ফিরে আসবে না। কিন্তু স্বাধীন দেশের লাল-সবুজের পতাকা মাথার ওপর যখন বাতাসে পত-পত করে উড়ছিল, তখন কমান্ডার রফিক তার মাথায় হাত রেখে বললেন, আজ থেকে তুমি শুধু রবি না,তুমি আমাদের কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা। তুমি আমাদের গৌরব। তোমার কথা এদেশ কখনো ভুলবে না।





















































