এম আনোয়ার হোসেন »
আমাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি ও গবেষণার অধ্যায়ে উজ্জ্বল বিভা ছড়িয়েছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। আজ তাঁর ১৫০তম জন্মদিন। তাঁর সার্ধশত জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে এই মনীষীর সৃজনসম্ভার নিয়ে দেশব্যাপী বিশদ আলোচন, তাঁর কর্ম ও জীবনসাধনার পুনর্পাঠ হবে।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ তাঁর গবেষণার জন্য উভয় বাংলায় স্বীকৃত ও সম্মানিত। তিনি মধ্যযুগের মুসলিম লেখকদের আবিষ্কার করেন। তাঁদের সাহিত্যকর্ম উদ্ধার করেন। প্রবল পরিশ্রমে, অসংখ্য পুঁথি সংগ্রহ করেছেন জীবনভর।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ আবিষ্কার করেন মধ্যযুগীয় বাঙালি কবি চট্টগ্রামের দৌলত উজির বাহরাম খাঁ কে। মধ্যযুগীয় এই কবির প্রসিদ্ধ সাহিত্যকর্ম হচ্ছে লাইলী-মজনু। মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওলকেও আবিষ্কার করেন তিনি। প্রখ্যাত আধুনিক সাহিত্যিক ও ভাষাবিজ্ঞানী ড.মনিরুজ্জামান তাঁর ‘সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে লিখেছেন,-“ তিনিই যে সেই আবদুল করিম, পটিয়ার মুন্সি সাহেব, জনগণের সাহিত্যসাগর ও বিজ্ঞজনের ‘সাহিত্যবিশারদ’ এতে সন্দেহ কি ! আমাদের এমন ঐতিহ্যবাহী সম্পদ আবিষ্কার ও আহরণের জন্যে এই মহান পুরুষ আমাদের আগামী প্রজন্মের কাছে চিরদিনই এক অমোঘ প্রেরণা ও পাথেয় হয়ে থাকবেন।”
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ হিন্দু-মুসলিমের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পুঁথি সংগ্রহের দুর্লভ কাজ সম্পাদন করতে কোন বাধার কাছে নতি স্বীকার করেননি। তিনি বিভিন্ন দূর-দূরান্তে গিয়ে পুঁথি সংগ্রহ করেছেন। পুঁথি সংগ্রহ করতে গিয়ে তিনি এক সময় স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বসলেন। এ কারণে ব্রিটিশ সরকারের রোষানলে পড়তে হয় তাঁকে। এবং বিধি ভঙ্গের দায়ে তিনি সরকারি চাকরি হারালেন। তাঁকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতার কারণে কবি নবীন সেনকে বদলি করা হয় কুমিল্লায়। তবু তিনি মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে পুঁথি সংগ্রহের কাজ অব্যাহত রেখেছিলেন। এভাবে তিনি আমাদের জন্যে রেখে গেছেন ‘দেড় হাজারের’ মতো দুষ্প্রাপ্য পুঁথি। যদিও তিনি ‘আড়াই হাজারের’ বেশি পুঁথি সংগ্রহ করেছিলেন। এর মধ্যে মুসলমান কবির পুঁথি ছিল প্রায় অর্ধেকেরও বেশি। তাঁর সংগ্রহের মধ্যে আলাওলের পদ্মাবতী কাব্যের ৪০ টি পাঠ উদ্ধারের তথ্য পাওয়া যায়। এভাবে তিনি বাংলা সাহিত্যের হারানো ধারাকে পুনরুদ্ধার করেন। পুনরুদ্ধার করেন চট্টগ্রামের মুসলিম কবিদেরকে, যারা কালগর্ভে হারিয়ে গিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় প্রায় ১৮৩ জন মুসলমান কবিকে তিনি আবিষ্কার করেন।
তিনি জীবদ্দশায় অসংখ্য পুঁথি বিভিন্ন সংগ্রশালায় দান করেন। এর মধ্যে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে ৫৪৭ টি পুঁথি, কলকাতা বিশ^বিদ্যালয় ও রাজশাহীর বরেন্দ্র যাদুঘরে দান করেন। বিতরণের পরও তার সংগ্রহশালায় যা অবশিষ্ট ছিল তা পরে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ে সংগৃহীত হয়। পুঁথি পরিচিতি নামে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ বিশ^বিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত পা-ুলিপিগুলোর তালিকা প্রকাশ করেছে। অধ্যাপক ড.আনিসুজ্জামান বলেন, “শুধু সংখ্যা নিয়ে আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সংগ্রহের তাৎপর্য উপলব্ধি করা যাবে না। বস্তুতঃ তিনিই আমাদের মধ্যযুগের মুসলিম কবিদের সাথে প্রথম পরিচয় করান। ড. মনিরুজ্জামান লিখেছেন,-“ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর আবিষ্কারের আগে যেমন বাংলা সাহিত্যে বৌদ্ধ অবদান অজ্ঞতাপুর্ব ছিল, তেমনি সাহিত্য বিশারদের আবিষ্কারের আগে মুসলমানদের অবদানও অস্বীকৃত, অপ্রতিষ্ঠিত এবং অকল্পিত ছিল।” বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে দেখা যায়, সাহিত্য বিশারদই প্রথম মানুষ, যিনি হিন্দু, বৌদ্ধ ও মুসলমান সম্প্রদায় ভেদাভেদ না করে প্রত্যেকের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বাঙালির কীর্তির নিদর্শন উদ্ধার করেন।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের জীবনকাল ছিল প্রায় ৮৩ বছরের। বলা যায়, তাঁর জীবন ছিল বৈচিত্র্যময় ও সংগ্রামশীল। তিনি ব্রিটিশ শাসনামলে ১১ অক্টোবর, ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে তদানীন্তন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির চট্ট্রগ্রামের বর্তমান পটিয়া উপজেলার অন্তর্গত সুচক্রদ-ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুনসি নুরউদ্দিন (১৮৩৮-৭১) এবং মাতার নাম মিসরীজান (মৃত্যু-১৮৮৭/৮৮)। মাত্র ১১ বছরের বছর বয়সে বদিউন্নিসার সাথে তার বিবাহ সম্পন্ন হয়। তাঁর একমাত্র কন্যা ছিলেন আলতাফুন্নেসা (১৯০১-৭৭ খ্রি.)। তিনি ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইহলোক ত্যাগ করেন। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে পটিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে এন্ট্রান্স বা এসএসসি পাস করার পর তিনি চট্টগ্রাম কলেজে এফ এ অধ্যয়ন করেন। কিন্তু টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। আরবি,ফারসি ও বাংলায় হাতে খড়ি হলেও তিনি সংস্কৃতও অধ্যয়ন করেন। এর পর তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাদ দিয়ে চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল স্কুলে (১৮৯৫) শিক্ষকতা করেন। পরে সীতাকু- মধ্য ইংরেজী স্কুলে অস্থায়ী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। এ সময় তিনি সম্পুর্ণ নতুন কিছু বৈঞ্চব পদাবলী উদ্ধার করেন। যা কলকাতার (-গলি) ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হতে থাকলে তিনি বেশ পরিচিত হয়ে উঠেন। এ সময় তিনি ‘রাধিকার মানভঙ্গ’ কাব্যটি সম্পাদনা করে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। পাশাপাশি সুরেশ সমাজপতির বিখ্যাত ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় তাঁর কিছু লেখা প্রকাশ হয়। তাঁর এ সব র্কীতি দেখে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী সম্পাদকীয়তে সাহিত্য বিশারদকে সম্মানিত করতে দ্বিধা করেননি। বঙ্গভঙ্গ রদের সময় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রাম বিভাগীয় ইন্সপেক্টর অব স্কুল অফিসে দ্বিতীয় শ্রেণীর সহকারী পদে যোগ দেন। ৬৫ বছর বয়সে তিনি এখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন। চাকরি শেষে তিনি পুঁথি সাহিত্য সংগ্রহের পাশাপাশি দেশসেবায়ও ব্রতী হলেন। তাঁকে সম্মান জানিয়ে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে প্রশ্নকর্তা ও পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। এমন কি স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় তাকে সম্মান জানিয়ে কলকাতা বিশ^বিদ্যালয়ের বি.এ পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে নিয়োগ করেন। ১৯৫২ সালে কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত সংস্কৃতি সম্মেলনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। এ ছাড়াও তিনি চট্টগ্রামে সাহিত্য সম্মেলন (১৯৫১), নদীয়া (১৯২০), কলকাতা (১৯৩৯) এবং নাটোরসহ বিভিন্ন সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন ও উদ্বোধনী ভাষণ দান করেন।
তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে- রাধিকার মানভঙ্গ (১৯০১), সত্য নারায়ণের পুঁথি (১৯১৫), মৃগলুব্ধ (১৯১৫), মৃগলুুব্দ সংবাদ (১৯১৫), গঙ্গামঙ্গল (১৯১৬), শ্রী গৌরাঙ্গ সন্ন্যাস (১৯১৭), সারদামঙ্গল (১৯১৭), কানু ফকিরের ‘জ্ঞান সাগর’ (১৯১৭), ফয়জুল্লাহর ‘গোরক্ষ বিজয়’ (১৯১৭), আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ ( মৃত্যুর আগে এবং মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় থেকেও আংশিক প্রকাশিত,১৯৭৭), আরাকান রাজসভায় বাঙ্গালা সাহিত্য (যৌথ,১৯৩৫) (১৪)।
লেখক : কলামিস্ট ও প্রাবন্ধিক