সৈয়দ মামুনুর রশীদ »
প্রয়াত পরাণ রহমান নানামূখী জনকল্যাণমূলক কাজের বদৌলতে চট্টগ্রামের সর্বস্তরের জনগণের কাছে “পরাণ আপা” নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। সমাজসেবা এবং নারী উন্নয়নের মহান ব্রত নিয়ে তিনি স্বাধীনতাত্তোর যুদ্ধবিধস্ত দেশে চট্টগ্রামে প্রথম রেজিস্টার্ড এনজিও “ঘাসফুল” প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যক্তিগত জীবনে নির্লোভ, সজ্জন ছিলেন তিনি। তাঁর ‘মা’ মরহুমা সাজেদা খাতুনও ছিলেন সংস্কারমুক্ত, বিদ্যানুরাগী, অনগ্রসর নারী সমাজের উন্নয়নকামী, পরোপকারী এক বিদুষী মহিলা। সুতরাং শামসুন্নাহার রহমান পরাণ পারিবারিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অতি শৈশবেই শিক্ষা পেয়েছিলেন অসহায় নির্যাতিত আর্তমানবতার সেবা করা মানে বিলাসিতা নয়, পরিচিতি কিংবা প্রতিপত্তি নয়, মানবকল্যাণ মানে সামাজিক দায়বদ্ধতা, জন্মের ঋণ শোধ। সমাজের অনগ্রসর নারী ও শিশুদের কল্যাণ এবং দেশ গঠনে কাজ করতে গিয়ে তিনি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চষে বেড়িয়েছেন। দিনরাত ঘুরে বেড়িয়েছেন শহরের বস্তিতে বস্তিতে। তিনি নগরীর পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের আবাসস্থল; সুইপার কলোনিগুলোতে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছেন পরম মমতায়। সাধারণ মানুষের কাছে অচ্ছুৎ সম্প্রদায় এই পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের বাসায় বাসায় গিয়ে নিয়মিত সুখ-দুখের খবর নিতেন। তিনি অংশগ্রহণ করেছেন স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা এবং মহিলা ও শিশু উন্নয়ন বিষয়ক দেশ বিদেশে অনুষ্ঠিত জাতীয় আন্তর্জাতিক সভা, সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাধর্মী কাজে। সমাজের নানা অনিয়ম, দুর্ভোগ নির্যাতিত নারীদের কথা বলতে গিয়ে কখনো কখনো তিনি হাতে তুলে নিয়েছেন কলম। দেশের জাতীয় এবং স্থানীয়ভাবে প্রকাশিত বিভিন্ন দৈনিকে লেখার পাশাপাশি রচনা করেছেন ছোট গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ। তাঁর গল্প, প্রবন্ধ, সাক্ষাতকার কিংবা কবিতায় উপলব্ধি করা যায় সমাজের নির্যাতিত নারী ও শিশুদের প্রতি গভীর মমত্ববোধ এবং উন্নয়নের আকুলতা।
শামসুন্নাহার রহমান পরাণ মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনে স্ব-প্রণোদিত হয়ে সমাজসেবায় আত্মনিয়োগ করেন। “ঘাসফুল”এর মাধ্যমে শুরুতে চট্টগ্রামে রিলিফ-ওয়ার্ক এর কাজ হাতে নেন। তিনি দলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রতীক হিসেবে সংগঠনটির নাম দিলেন, “ঘাসফুল”। তিনি মনে করতেন, প্রকৃতিতে ঘাসফুল যেমন ফুল হয়ে ফুটলেও ফুলের মার্যাদা পায় না, নির্বিচারে কিংবা অকারণে পদদলিত হয় তেমনি সমাজের সুবিধাবঞ্চিত তৃণমুল মানুষগুলো মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেও মানুষের মার্যাদা পায় না। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পাহাড়সম প্রতিকূলতার মাঝে ‘ঘাসফুল’ নিভৃতে নিরলসভাবে কাজ করতে থাকে চট্টগ্রাম শহরের বস্তিতে-বস্তিতে। নিরবচ্ছিন্ন কর্ম-প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ প্রতিষ্ঠানটি ১৯৭৮ সালে চট্টগ্রাম জেলা পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধন স্বীকৃতি লাভ করে এবং এতে প্রতিষ্ঠানটি চট্টগ্রাম বিভাগের প্রথম রেজিস্ট্রার্ড এনজিও’র মর্যাদা পায়।
পরাণ রহমান সমাজের প্রায় শতাধিক দুস্থ মহিলাদের উন্নতমানের ধাত্রী প্রশিক্ষণ দিয়ে মহল্লায়-মহল্লায় নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করার পাশাপাশি তাদের কাজের বন্দোবস্ত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এতে করে ওই সকল দুস্থ মহিলারা সমাজ উন্নয়নে অংশগ্রহণ, নিজের আয়-রোজগারের পাশাপাশি সামাজিক মর্যাদাও লাভ করে। এলক্ষ্যে সমাজের নি¤œআয়ের মানুষগুলোর পাড়ায় এসকল প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের বাড়ির সামনে তিনি তাদের নামে সাইনবোর্ড স্থাপন করেন। তিনি অতিযতেœ গড়া নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতকরণে নিয়োজিত এসকল প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের কর্ম-জীবন, পারিবারিক জীবন নিয়ে একটি গ্রন্থ লিখলেন, “তৃণমূলের রমণী”।
উন্নয়নকর্মী শামসুন্নাহার রহমান পরাণ সত্তর দশকের শেষ এবং আশির দশকের প্রথমদিকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাংলাদেশের কোস্টাল অঞ্চলে বসবাসকারী তৃণমূল মৎস্যজীবীদের উন্নয়নে “বে-অব-বেঙ্গল” নামক এক প্রকল্পের মাধ্যমে কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড়ে জেলেদের জীবন-মান উন্নয়নে বহু কাজ করে গেছেন। যা এখন উন্নয়ন সেক্টরে এক বিস্মৃত অধ্যায়। পরাণ রহমানের এই কর্ম-ইতিহাস উপকূলীয় মানুষের কল্যাণে বর্তমানে যে সকল উন্নয়ন সংস্থাসমুহ (এনজিও) কাজ করছে তাদের জন্যে কিংবা যারা এবিষয়ে গবেষণা করছেন বা আরো নতুন নতুন বিষয়ে নবীন কোন গবেষক আসবেন তাদের জন্যে বাতিঘরের মতো পথ-নির্দেশনা হিসেবে কাজ করবে নিশ্চিত। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন এর সহযোগিতায় থাই নাগরিক ‘মিস্ পাচালী’সহ কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণপাড়ে তিনি চট্টগ্রামের চরলক্ষ্যা, ডাঙ্গারচর, আল্যার’চর এলাকার অধিবাসীদের নিয়ে বিশেষ করে জেলেদের উন্নয়নে প্রচুর কাজ করেছেন। এই বিশেষ কাজের সূত্র ধরে তিনি উপকুলীয় দেশ; মালদ্বীপ, ইন্দোনেশিয়া, মালেশিয়া, শ্রীলংকাসহ থাইল্যান্ডের বিভিন্ন উন্নয়নকর্মী, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে একটি যোগসূত্র রচনা করেছিলেন।
পরাণ রহমানের হাত ধরে, পরামর্শ ও সহযোগিতায় চট্টগ্রামে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের জন্ম হয় এবং ডালপালা মেলে বেড়ে উঠে প্রতিষ্ঠিত সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয়েছে উন্নয়নের নানা শাখায়।
শুধু এনজিও সেক্টর নয় তিনি ব্যাপ্তি ঘটিয়েছেন মানবকল্যাণের প্রতিটি শাখায়। পরাণ রহমান সত্তরের দশকে তৎকালীন চট্টগ্রাম পৌরসভার ওয়ার্ড কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮৭-৮৮ সালে ‘লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং’ এর প্রেসিডেন্টে হন। এছাড়াও তিনি ১৯৯৫ সালে ‘লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং পারিজাত’ এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট এবং ২০০৮ সালে ‘লায়ন্স ক্লাব অব চিটাগাং পারিজাত এলিট’ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি লায়ন্স এর একজন সম্মানিত মেলবোর্ন জোন্স ফেলো (এমজেএফ)। ১৯৮৯-১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি ‘বাংলাদেশ মহিলা সমিতি’ চট্টগ্রাম এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং ১৯৮৯ সাল থেকে চিটাগাং ওয়ার্কিং ওমেন কো-অপারেটিভ লি. এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি চট্টগ্রাম কারাগারের কারা-পরিদর্শক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ এর প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং সচেতন ও কাল-উপযোগী লেখার জন্য তিনি বহুবার সর্ম্বধনা লাভ করেন। ঢাকার নন্দিনী প্রকাশনাসহ আরো বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে তাঁর পাঁচটি ছোটগল্পের বই প্রকাশিত হয়।
ব্যক্তিজীবনে পরাণ রহমান কেমন ছিলেন! তিনি তাঁর সংস্থার প্রতিটি কর্মচারী-কর্মকর্তার মাধ্যমে তাদের বাবা-মা, স্ত্রী, পরিজনের সাথে পারিবারিক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন সংস্থার কর্মীদের জীবনে যদি সুখ-স্বাচ্ছন্দ আনা সম্ভব না হয়, তাহলে তাদেরকে দিয়ে সমাজের সুখ-স্বাচ্ছন্দ কিংবা উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাইতো দেখা যেতো তাঁর কাছে সকল কর্মীরা তাদের দুঃখ- দুর্দিনে, বিপদ-আপদে ছুটে যেতেন। তিনি মাথার উপরে শীতল ছাতার মতো, অভিভাবকের মতো পরম মমতায় সব কথা মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। তিনি সংস্থার পিয়ন-আয়া কিংবা উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এমনকি বাসার গৃহকর্মীটিকেও বাইরের যে কোন মজলিশে সহকর্মী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতেন। যারা তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছেন, কথা বলেছেন, পরিচিত হয়েছেন তারা জানেন পরাণ রহমানের মধ্যে বহুধরণের বিরল মানবীয় গুণাবলী প্রকাশিত হতো। তাঁর মৃত্যু যে শুন্যতা সৃষ্টি করেছে তা পূরণ করার নয়। জীবন বহমান আগামীদিনে বহু সমাজকর্মী, উন্নয়নকর্মী, সমাজসেবক, নারীনেত্রী আসবেন। আমাদের বিশ্বাস পরাণ রহমানের জীবনাদর্শ, কর্মময় জীবন-আলেখ্য নবীনদের জন্য বাতিঘরের মতো দিক-নির্দেশনা দিতে সক্ষম হবে।
এই মহীয়সী নারী শামসুন্নাহার রহমান পরাণ ২০১৫ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বর্ণাঢ্য কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে। সূফি পরিবারের সন্তান হিসেবে তিনি সৎ ও মানবতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে গেছেন। তাঁর কাজই ছিল বস্তিতে বস্তিতে ঘুরে ঘুরে, দরিদ্র নারীদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে আয়-উপার্জনের পথ ধরিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলা। তিনি নির্যাতিত নিপীড়িত নারী ও শিশুর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করেছেন, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায়, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত ছিলেন। সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর অগ্রযাত্রা সুগম করেছেন। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ প্রবীণদের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও কল্যাণমুলক কাজে তিনি সদা সোচ্চার ছিলেন। মানুষের সাথে মানুষের ব্যবধান কমিয়ে একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন। তিনি গত চার দশকেরও বেশি সময় ক্লান্তিহীনভাবে এই কাজই করে গেছেন। তাঁর দীর্ঘ পথচলায় মানুষ ভালবেসে বহু পুরষ্কার, সম্মান, সম্বর্ধনায় ভূষিত করলেও জীবদ্দশায় রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যক্তি পরাণ রহমানকে কখনো সম্মানিত করা হয়নি, যা তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী, অনুরাগীদের মধ্যে গভীর দুঃখবোধ থেকে যায়।
দুখী মানুষগুলোর দুঃখ ঘোচাতে নীলকণ্ঠী হয়েছেন তিনি নিজে। পঁচাত্তর বছর ধরে হেঁটে হেঁটে তিনি বর্ণাঢ্য এক ইতিহাসের পর্দা টেনে দিলেন ১৮ ফেব্রুয়ারি সুবেহ সাদিকের কিঞ্চিৎ পরে। তাঁর সৃষ্টি দলিত ঘাসফুল এখন এক পরিপক্ক মহীরূহ। হাজার খানেক মানুষের জীবন-জীবিকা, রুটি-রুজির কর্মসংস্থান। সংস্থাটির উন্নয়ন ছাতায় ঢেকে রেখেছে প্রায় সাড়ে তিনলক্ষ মানুষের জীবন। আমরা কখনো ভুলবো না! ভুলতে পারি না! স্মরণে, শ্রদ্ধায় তাঁকে মনে রাখা আমাদের এক জনমের দায়!
লেখক : কবি ও উন্নয়নকর্মী
ঃড়ঃধষসধসঁহ@ুধযড়ড়.পড়স