সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা বাণিজ্য যত কম করবে ততই ভালো

চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়ন, ট্যারিফ ও পরিচালনা নিয়ে আমরা কথা বলেছি বাংলাদেশ সরকারের অতিরিক্ত সচিব (অব) ও সাবেক সদস্য (প্রশাসন ও পরিকল্পনা), চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ-মো. জাফর আলমের সঙ্গে। ধারাবাহিক আলোচনার ১ম পর্ব প্রকাশিত হল আজ।

সুপ্রভাত : চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠানো ও নামানোর জন্য বর্তমানে চারটি কন্টেইনার টার্মিনাল আছে। এগুলো হচ্ছে পিসিটি, সিসিটি, জিসিবি ও এনসিটি। পতেঙ্গা কন্টেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) পরিচালনা করছে সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি)। এটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় ২০২৪ সালের জুনে। টার্মিনাল নির্মাণে বন্দর কর্তৃপক্ষ ১ হাজার ৮৮৬ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। আর বিদেশি অপারেটরদের বিনিয়োগ করার কথা ২ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। এক বছরেরও বেশি সময় হয়ে গেলেও প্রতিশ্রুত বিনিয়োগ এখনও হয়নি। মন্তব্য করুন।
জাফর আলম : পিসিটিতে কাক্সিক্ষত ফলাফল আমরা এখনো পাচ্ছি না এবং পাওয়ার কথাও না। ওইটাতে একটা কনসেশন এগ্রিমেন্ট হয়েছে। পিসিটিতে একটা এগ্রিমেন্ট হয়েছে, চুক্তি হয়েছে। ওই চুক্তিতে সংখ্যা নির্ধারণ করা আছে। প্রথম বছর ৫০ হাজার টিউজ, তারপরে ১ লাখ, তারপরে ২ লাখ, ৩ লাখ, ৪ লাখ। যদি ৫০ হাজার না করতে পারে তাহলে যতটুকু করতে পারবে না ১৮ ডলার করে সেই পরিমাণ টিউজের অর্থ বন্দরকে ক্ষতিপূরণ দেবে।
এটা করতে পারেনি, ফেইলিওর। এটাকে বলে ভিজিএফ-ভায়েবিলিটি গ্যাপ ফাইন্যান্সিং। যে কোনো কন্ট্রাক্ট হয় পিপিপি মডেলে অথবা কনসেশন এগ্রিমেন্টে একটা চুক্তি থাকে। যেমন আমরা ঢাকায় মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার, ওখানে চুক্তির মধ্যে ছিল এক লাখ গাড়ি যাবে, তো এক লাখ গাড়ি যদি না যায়, তাহলে যতটুকু যাবে না সেটা সরকার দেবে। এগুলোতে যদি কম করে রাখা হয় তাহলে সরকারের দুই দিক থেকে লস হয়। এক্ষেত্রে পিসিটির ক্ষেত্রে আপত দৃষ্টিতে লস হচ্ছে না। কিন্তু খুব দ্রুত ইকুইপমেন্ট সংযোজন করার পর যদি হ্যান্ডলিং করা হতো তাহলে আমাদের পণ্য তাড়াতাড়ি আসতো, ইন্ডস্ট্রিয়াল গ্রোথ বাড়তো।
পিসিটিতে চার্জ কম বলা যায় একদিক দিয়ে, এনসিটিতে আমরা পাই ৪৮ ডলার, ওখানে আমরা পাবো ১৮ ডলার উইথ আউট ইনভেষ্টমেন্ট। ২২ মিলিয়ন ডলার আগেই দিয়েছে পোর্টকে। তো ২২ মিলিয়ন ডলারকে এফডিআর করে দেওয়া হয়েছে। ওইদিক থেকে এই চুক্তিটা আমার মনে হয়, যতগুলো কনসেশন এগ্রিমেন্ট হয় সেদিক দিয়ে এটা মোটামুটি একটা জায়গায় আছে। তবে আরও কমপিটেটিভ যদি হতো তাহলে আমার মনে হয়, আমরা ২২ এর জায়গায় ২৫ মিলিয়ন ডলার পেতাম। আমরা ১৮-এর জায়গায় ২২-২৩ ডলার পেতাম।

সুপ্রভাত : নিউমুরিং কন্টেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) এককভাবে বন্দরের ৪৪ শতাংশ কন্টেইনার ওঠা-নামা করে। জুলাই মাসের শুরুতে সাইফ পাওয়ারটেককে সরিয়ে এনসিটি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় নৌবাহিনী পরিচালিত প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম ড্রাইডক লিমিটেডকে। কার্যক্রমে বেশ কিছু সংস্কার ও পরিবর্তন আনায় অল্প সময়েই উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। পতেঙ্গা টার্মিনালের জন্য বন্দরের বিনিয়োগ কেবল জেটি নির্মাণে। আর নিউমুরিংয়ের জন্য বিনিয়োগ জেটির পাশাপাশি যন্ত্রপাতিতেও। বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই বড় বিনিয়োগ করে ফেলেছে এনসিটিতে। সেই রেডিমেড টার্মিনালটি বিদেশি অপারেটরের বড় বিনিয়োগ ছাড়াই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। দেশি অপারেটর দিয়ে চালিয়ে লাভজনক চলতে থাকা ও সাফল্য পাওয়ার পরেও আগামী ডিসেম্বরে আবুধাবি ভিত্তিক ডিপিওয়ার্ল্ডকে এই টার্মিনালের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়াটা কি সঠিক হচ্ছে?
জাফর আলম : এনসিটি কিছুদিন আগে একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে চালানোর জন্যে। আমরা কিছু কিছু তথ্য পত্রিকায় দেখি, বলা হচ্ছে তারা ভালো করছে। কিন্তু এই ভালো যিনি বলছেন তিনি বললেই ভালো বলা যায় না। এটার ভেতরে কত কস্ট (খরচ) কম হচ্ছে।
সাইফ পাওয়ারটেক প্রতি মাসের জন্য সাড়ে ছয় কোটি টাকা পেত পোর্টের কাছ থেকে হ্যান্ডলিং বাবদ। এখন কি সাড়ে ছয় কোটি টাকাই পাচ্ছে? এখন কি বেশি পাচ্ছে নাকি কম পাচ্ছে? দ্যাট ইজ দি ভাইটাল কোশ্চেন। এখন কি হ্যান্ডলিং বেড়ে গেছে? কত বেড়েছে এটার স্ট্যাটিসটিক্স কাস্টমস এবং পোর্ট দুইটা মিলে ভেরিফাই করতে হবে। কারণ একটা পরিসংখ্যান বলে দিলে হয় না, পোর্ট এমন কোনো মেকানিজম নাই। একই ইকুইপমেন্ট, একই লোকজন, একই অপারেটরের লোকজন, সবাই ঠিক আছে। এটা বেড়ে যাওয়া হয়তো দুই, চার, ১০টা, ২০টা বাড়বে।
আমরা বিভিন্নভাবে সময় বলে থাকি যে দুবাইকে দেওয়া হচ্ছে অথবা সৌদি আরবকে দেওয়া হচ্ছে এই কথাগুলো না বলে আমাদের বলতে হবে, গ্লোবাল টার্মিনাল অপারেটরকে দেওয়া হচ্ছে। কারণ ওই জিটিও বা , গ্লোবাল টার্মিনাল অপারেটররা সারা দুনিয়াতে ৭০-৮০ টা করে পোর্ট চালায়, অপারেট করে।
ডিপিওয়ার্ল্ডকে আমেরিকা বের করে দিয়েছে। এটা এক ধরনের গল্প। আমি এটার ভেতরের খবর নিয়েছি, ইনল্যান্ড টার্মিনালের ১০-১২টা ডিপিওয়ার্ল্ড চালায়।
এখন আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে যে, এনসিটি দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে কিনা। এইটা আমি খুব স্পষ্টভাবে বলেছি যে গ্রিনফিল্ড পোর্ট, যেটা বে টার্মিনাল বলেন, এপিএমের যেটা লালদিয়াতে হচ্ছে অথবা মাতারবাড়িতে হচ্ছে এইরকম পোর্টগুলোকে আপনি গ্লোবাল টার্মিনাল অপারেটরকে দিতে খুব একটা হেজিটেশন হওয়ার কোনো দরকার নেই। এটা চোখ বন্ধ করে চুক্তিটা কেমন হবে এইটা নিয়ে নেগোসিয়েট করেই দেওয়া যায়। কারণ এখানে জনবল নেই, ইনভেস্টমেন্ট নেই, কোনো কিছু নেই। শুধু মাটিটা আমার। কিন্তু যেখানে আমার ইনভেস্টমেন্ট আছে, এনসিটির ক্ষেত্রে, আমার ওয়ান অফ দা বেস্ট টার্মিনাল, ইন আওয়ার ক্যালকুলেশন, আমাদের ক্যালকুলেশন, আমাদের চুক্তির মধ্যে বেস্ট। কিন্তু ওটা যে গ্লোবালি বেস্ট এটা বলা যাবে না। কারণ ওটা ১৮ থেকে ২০ টিইউজ কন্টেনার হ্যান্ডেল করে প্রতি ঘণ্টায়। আর গ্লোবাল টার্মিনাল অপারেটররা ৩০ থেকে ৩৫টা, কেউ কেউ চল্লিশও করে। আপনি যখনই এটা বাইরে কাউকে দিবেন, তখন আপনার ক্যালকুলেশন করতে হবে যে আপনার কত পার্সেন্ট ফাস্ট হবে। আমি নিজেই ডিবিওয়ার্ল্ডে গিয়েছিলাম। তখন আমাদেরকে বলা হয়েছে, ৩০ পার্সেন্ট এনহ্যান্স করে দিতে পারবে তারা। অল্প খরচে ৩০ পার্সেন্ট এনহ্যান্স করে দিবে বিকজ দে হ্যাভ দেয়ার ক্যাপাসিটি। ডিবিওয়ার্ল্ডের নিজস্ব হোম বিল্ড সফটওয়্যার দিয়ে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং মনিটর করে এবং তারা সাকসেসফুলি হ্যান্ডল করে।
এনসিটি দেওয়ার ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েই আগাচ্ছে। মাঝখানের সময়টা চালিয়ে নেয়ার জন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ব্যবসা বাণিজ্য যত কম করবে ততই ভালো।

সুপ্রভাত : সম্প্রতি ট্যারিফ কাঠামোতেও পরিবর্তন এনেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নতুন করে তাদের ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ শুল্ক বাড়ানো প্রস্তাবে অনুমোদন দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। হঠাৎ এত বেশি ট্যারিফ বাড়াতে হবে কেন? বন্দর তো লসে নেই?
জাফর আলম : বন্দর লসে চলার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান না। বন্দর কস্টবেসড ট্যারিফে চলবে। কস্টবেসড ট্যারিফ মানে বন্দর যে আয় করবে ওই আয় দিয়ে পরিচালন ব্যয় করবে। ওই যে ইকুইপমেন্ট কিনবে, ইকুইপমেন্টের জন্য আবার প্রতিটা ইকুইপমেন্টের লাইফটাইম আছে বিশ বছর, পঁচিশ বছর। তার মানে ওর ডেপ্রিসিএশনের অর্থও সে জমা করবে। তার মানে নিজে পরিচালিত হবে। ইকুইপমেন্ট, জাহাজসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কিনবে। সরকার টাকা দেয় না বন্দরকে, তো সময়ের পরে যাতে ওই জাহাজ কিনতে পারে ওই টাকাটাও সে সংগ্রহ করে রাখবে। আরেকটা হচ্ছে যদি তার এক্সপানশনের প্রয়োজন হয়, যদি ইকোনমি ডিমান্ড করে তাহলে নতুন করে বন্দর বানাবে। যেমন পিসিটি আমরা বানালাম। আমরা জমি কিনে দিলাম মাতারবাড়িতে। আমরা জমি কিনে দিলাম বে টার্মিনালে। এগুলো আমরা দিয়েছি। তারপরে লোন নিচ্ছি আমরা। লোন নিলাম জাইকা থেকে মাতারবাড়িতে। এখানে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক থেকে ছয়শ পঞ্চাশ মিলিয়ন ডলার লোন নিব। এটাও শোধ করতে হবে পোর্টকে। সরকার করে না কিন্তু। যার ফলে অনেকে ট্যারিফ বললে ঘাবড়ায় যান। কিন্তু ট্যারিফ তো অবশ্যই এসপার হতে হবে গ্লোবালি যারা করে তাদের মতো করে এবং এটা আমাদের যে ট্যারিফটা ছিল সেটা হচ্ছে ১৯৮৬ সালের। এবং মাঝখানে আট, দশটা, বারোটা আইটেমের ট্যারিফ পরিবর্তন ঘটেছিল।
যাদেরকে কনসালটেন্ট নিয়োগ করা হয়েছিল ট্যারিফ নির্ধারণের ব্যাপারে তারা কিন্তু আশেপাশের বন্দরগুলো অবশ্যই দেখে ট্যারিফ নির্ধারণ করেছে। এমনি করবে না।
ট্যারিফ একটা এমন কোনো জিনিস না, যেটা একবার বানানোর পর ঘুমিয়ে থাকা যাবে। ভারতের সমস্ত বন্দরের জন্যে পারমানেন্ট ট্যারিফ অথরিটি আছে। মেজর পোর্ট ট্যারিফ অথরিটি তারা তিন মাস পর, ছয় মাস পর কোনো কিছু ঘটলেই ট্যারিফ অ্যাডজাস্ট করে। তখন আঘাত-প্রতিঘাতগুলো এতো ছোট ছোট হয় টের পাওয়া যায় না। ৮৬-র পর এখন যদি বাড়ে তখন একটু বড় মনে হবেই। তারপরেও আমাদের এ সময়ে ট্যারিফ নির্ধারণ একটু চিন্তাভাবনা করে করা উচিত।
(আগামীকাল ২য় পর্ব)