মহেশখালীর এসপিএম প্রকল্প
৮০০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে
সুপ্রভাত ডেস্ক »
পরীক্ষামূলকভাবে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের সরবরাহ শুরু হয়েছে কক্সবাজারের মহেশখালীর সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্পে (এসপিএম)। গভীর সাগরে অবস্থান করা ট্যাংকার জাহাজ ‘এমটি হোরে’ থেকে রোববার (২ জুলাই) দুপুরে পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাস শুরু হয়। পাইপলাইনের মাধ্যমে এখান থেকে অপরিশোধিত তেল চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে যাবে।এমটি হোরে সৌদি আরব থেকে আমদানি করা তেলের চালান নিয়ে আসে গত ২৪ জুন। এপর্যন্ত বাংলাদেশ আসা সর্ববৃহৎ ক্রুড অয়েলবাহী ট্যাংকার জাহাজ এটি।এসপিএমের পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরুর মধ্যে দিয়ে আমদানি করা জ্বালানি তেল পরিবহন ও সঞ্চালনে নতুন প্রযুক্তিতে যুক্ত হলো বাংলাদেশ।
প্রায় ৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং প্রকল্পে (এসপিএম) পরীক্ষামূলকভাবে সাগর থেকে জ্বালানি তেল খালাসের এই কার্যক্রম সফল হলে আগামী আগস্ট মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পটির উদ্বোধন করবেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত।
তিনি বলেন, ‘২৪ জুন রাতে সৌদি আরব থেকে আমদানি করা ৮২ হাজার টন ক্রুড অয়েলবাহী জাহাজ ‘এমটি হোরে’ মহেশখালীতে মুরিং পয়েন্টের কাছাকাছি সাগরে এসে পৌঁছায়। পরদিন ২৫ জুন দুপুরে পরীক্ষামূলক কমিশনিং করার কথা থাকলেও, বৈরি আবহাওয়ার কারণে তা স্থগিত করা হয়। এরপর রোববার (২ জুলাই) দুপুরে এসপিএম প্রকল্পের পরীক্ষামূলক কমিশনিং শুরু হয়েছে। যার মাধ্যমে আগামী তিনদিনের মধ্যে জাহাজটির ক্রুড অয়েল খালাস করা হবে। পরবর্তী তেলবাহী জাহাজ এলে দ্বিতীয় পাইপলাইনের কমিশনিং করা হবে।’
শরীফ হাসনাত আরও জানান, অপরিশোধিত তেল নিয়ে আসা জাহাজটি মাতারবাড়ী এলাকায় সাগরে নির্মিত মুরিংয়ে যুক্ত করা এবং পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল খালাসের কার্যক্রমে সহযোগিতা করছেন চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। ডাবল পাইপ লাইনে তেল খালাসের এই কার্যক্রমে বছরে সরকারের ৮’শ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।
তিনি বলেন, প্রকল্পের মূল কাজের অংশ হিসেবে ১৪৬ কিলোমিটার অফশোরে ও ৭৪ কিলোমিটার অনশোরসহ মোট ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপনের কাজ শেষ হয়েছে। সাগরের তলদেশের এই পাইপলাইনের মাধ্যমে কালারমারছড়ার সোনারপাড়ায় স্থাপন করা ট্যাংকে নেওয়া হচ্ছে আমদানি করা তেল।
‘কালারমারছড়ায় স্থাপন করা হয়েছে ৬০ হাজার ঘন মিটার অপরিশোধিত তেল ধারণে ৩টি এবং ৩০ হাজার ঘন মিটার ডিজেল ধারণ ক্ষমতার ৩টি রিজার্ভ ট্যাংক। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারে। এসপিএম প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ইউনিট। এটি চালুর মধ্য দিয়ে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হলো। পরীক্ষামূলক সরবরাহের মধ্য দিয়ে জ্বালানি ব্যবস্থাপনার নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ’ – যোগ করেন তিনি।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম সোহায়েল বলেন, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় জাহাজ এমটি হোরে সৌদি আরব থেকে ক্রুড অয়েল নিয়ে এসেছে। এই জাহাজে ৮২ হাজার মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল রয়েছে। জাহাজটি ২৩০ মিটার লম্বা এবং গভীরতা সাড়ে ১২ মিটার। জাহাজের ক্রুড অয়েল সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালীর কালারছড়ায় স্থাপিত ট্যাংকে খালাস করা হচ্ছে। এরপর সেখান থেকে ১৮ ইঞ্চি চওড়া পাইপে করে যাবে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারিতে, যা আগে কখনো হয়নি। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন এই কার্যক্রম করছে, এটি তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প। প্রকল্পটিকে সহায়তা করার জন্য এই জাহাজকে সাগরে নির্মিত মুরিংয়ে পয়েন্ট আনা এবং পাইপলাইনেযুক্ত করতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের সঙ্গে আমরাও কাজ করছি।’ খবর টিবিএস।
কক্সবাজার-২ (মহেশখালী-কুতুবদিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আশেক উল্লাহ রফিক বলেন, ‘বাংলাদেশে জ্বালানির চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে উত্তেজনা চলছে, এরমধ্যে টেকসই জ্বালানি মজুদ ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনা থাকা উচিত। সেজন্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসপিএম প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মহেশখালীর কালারমছড়ায় স্থাপিত ৬টি ট্যাংকের মধ্যে ৩টি ট্যাংকে ক্রুড অয়েল ও বাকি ৩টিতে ডিজেল সাগর থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে এনে মজুদ করা হবে। এরপর পৃথক দুটি পাইপলাইনে করে সেটি চট্টগ্রামে রিফাইনানিতে পৌঁছে যাবে।’
তিনি আরও বলেন, এতদিন গভীর সাগরে নোঙর করা বড় জাহাজ থেকে লাইটার জাহাজের মাধ্যমে জ্বালানি তেল বিশেষ করে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোড করতে সময় লাগতো ১১ থেকে ১২ দিন। এতে খরচও বেশি হতো, সময়ও বেশি লাগত। এখন এসপিএম প্রকল্পের মাধ্যমে মাত্র ৩ দিনের মধ্যে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোড করা যাবে। আর দ্রুত জাহাজ ছেড়ে দেয়া যাবে। ফলে জাহাজ ভাড়া বাঁচবে এবং খরচও কমে আসবে। এতে বছরে সরকারের বাঁচবে ৮০০ কোটি টাকা। এটা দেশের জন্য একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এসপিএম যেভাবে কাজ করবে
জ্বালানি বিভাগের তথ্যমতে, মহেশখালী উপজেলার কালারমারছড়া ইউনিয়নে উপকূল থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) স্থাপন করা হয়েছে। এসপিএম থেকে ৩৬ ইঞ্চি ব্যসের দুটি আলাদা পাইপলাইনের মাধ্যমে ক্রুড অয়েল ও ডিজেল আনলোডিং করা হবে।
১৬ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সেই পাইপলাইন প্রথমে নিয়ে আসা হবে কালারমারছড়ায় সিএসটিএফ বা পাম্প স্টেশন অ্যান্ড ট্যাংক ফার্মে। সেখান থেকে বিভিন্ন পাম্পের মাধ্যমে ৭৪ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে তেল চলে যাবে আনোয়ারার সমুদ্র উপকূলে। সেখান থেকে আবার ৩৬ কিলোমিটার পাইপলাইন পাড়ি দিয়ে তেল নিয়ে যাওয়া হবে পতেঙ্গায় ইআরএলের রিফাইনারিতে। এসব পাইপলাইনের ২০ হাজার টন ধারণ ক্ষমতা রয়েছে। এসপিএম থেকে মহেশখালীতে এসে যেখানে পাম্প হবে, সেখানে দুই লাখ টন ধারণ ক্ষমতার একটি স্টোরেজ নির্মাণ হয়েছে। এরমধ্যে অপরিশোধিত তেল থাকবে ১ লাখ ২৫ হাজার টন। বাকি ৭৫ হাজার টন থাকবে ডিজেল।
যা যা হলো কালারমারছড়ায়:
কালারমারছড়ার সোনারপাড়ার প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেয়া যায়, এ প্রকল্পের শুরুতে ১৯১ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। পরবর্তীতে সেটি ৯০ একরে নেমে আসে। সেখানে তিনটি পরিশোধিত ও তিনটি অপরিশোধিত তেলের স্টোরেজ ট্যাংকসহ অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। স্টোরেজ ট্যাংকগুলোতে আমদানি করা তেল মজুদ রাখা হবে। প্রতিটি পরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকারের ধারণ ক্ষমতা ৬০ হাজার ঘনমিটার ও অপরিশোধিত স্টোরেজ ট্যাংকের ধারণ ক্ষমতা ৩৫ হাজার ঘনমিটার। স্টোরেজ ট্যাংক ছাড়াও এই প্রকল্পের অভ্যন্তরে তিন ও দুই তলা বিশিষ্ট ১৮টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে আটটি অ্যাকুমেন্টেশন ভবন, দুটি ইলেক্ট্রনিক ও একটি আবাসিক ভবন রয়েছে। বাকিগুলো গুদাম, ক্লাবঘর ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন।
এছাড়া ব্যাক ভাল্ব স্টেশন, পিগিং স্টেশন, মিটারিং স্টেশন, স্কাডা, মেইন ও বুষ্টার পাম্প, জেনারেটর, সিকিউরিটি সিস্টেম ও ফায়ার ভেহিকেল, ফায়ার ওয়াটার নেটওয়ার্ক, পাম্প ও ওয়াটার স্টোরেজ সুবিধাদিসহ অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা রয়েছে প্রকল্পের অভ্যন্তরে। নিরাপত্তার জন্য ১৩টি ওয়াচ টাওয়ার, তিনতলা বিশিষ্ট দুটি গেইট ও চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। চারপাশে রয়েছে কাঁটাতারের বেষ্টনী। বর্তমানে জার্মানি ও চীনের ৫০ জন প্রকৌশলী কর্মরত রয়েছেন। যদিও প্রকল্পের শুরু থেকে ৫-৬ শত বিদেশি নাগরিক কর্মরত ছিলেন।
‘এসপিএম’ শাটডাউনের ব্যাকআপ :
বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বলছে, বর্তমানে দেশের তেল মজুদের সক্ষমতা রয়েছে সোয়া দুই মাসের। এসমপিএম প্রকল্প চালুর মধ্য দিয়ে আরো ১৫ দিনের সক্ষমতা বেড়ে আড়াই মাসে উন্নীত হবে। অন্যদিকে ১১ দিনের পরিবর্তে মাত্র ৪৮ থেকে ৭২ ঘন্টায় তেল খালাস করা হলে বছরে সরকারের বাঁচবে ৮০০ কোটি টাকা।
জ্বালানি বিভাগের তথ্য বলছে, দেশের একমাত্র রাষ্ট্রয়াত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত জ্বালানি তেল পরিশোধন করতে পারে। এসপিএম প্রকল্প প্রতিষ্ঠানটির দ্বিতীয় ইউনিট। এটি চালু হলে পরিশোধন ক্ষমতা ৪৫ লাখ টনে উন্নীত হবে।
এ ব্যাপারে কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, বিদেশ থেকে মাদার ভেসেলে আমদানি করা তেল লাইটার জাহাজে পতেঙ্গার ডিপোতে আনলোড করতে সময় নষ্ট হয়। এখন গভীর সমুদ্র বন্দরের কাছাকাছি এসপিএম বাস্তবায়ন হচ্ছে, এটি বিরাট গুরুত্ব বহন করে। পাশাপাশি দেশের স্টোরেজ ক্যাপাসিটিও অপ্রতুল। এ প্রকল্প চালুর মাধ্যমে বৈশ্বিক সংকটে দেশে জ্বালানির যে সমস্যা হয়, এই স্টোরেজে যদি তেলের মজুদ বাড়াতে পারে, সংকটকালীন সময়ে তা বিরাট ভূমিকা রাখবে। দামের ক্ষেত্রেও সাশ্রয় হবে।
ব্যয়ের সাথে বাড়ছে মেয়াদ
২০১৫ সালে নেওয়া প্রকল্পটি তিন বছরের মধ্যে শেষ করার কথা ছিল। কিন্তু তিন দফা সংশোধনের মাধ্যমে প্রকল্পের মেয়াদ এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়। কিন্তু, এতেও পুরোপুরি প্রস্তুত না হওয়ায়, চতুর্থ দফা সংশোধন করে মেয়াদ আরো এক বছর বাড়ানো হয়েছে। আর এতে ব্যয় বেড়েছে এক হাজার ২১৭ কোটি টাকা। মোট ব্যয় বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে এসপিএম প্রকল্প। এতে বৈদেশিক সহায়তা দিচ্ছে চায়না এক্সিম ব্যাংক। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অধীনে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে।
প্রকল্পটির ঠিকাদারের দায়িত্বে আছে চীনের রাষ্ট্রয়াত্ত কোম্পানি- চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড (সিপিপিইসি) এবং ইঞ্জিনিয়ারিং প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন (ইপিসি)। এতে জার্মানি-ভিত্তিক আইএলএফ কনসাল্টিং ইঞ্জিনিয়ার্স কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে।