সমীপে

মাননীয় মেয়র মহোদয়

কামরুল হাসান বাদল »

এই উপমহাদেশের প্রাচীনতম নগরের মধ্যে চট্টগ্রাম অন্যতম। মূলত প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বন্দরের কারণে চট্টগ্রাম এতদাঞ্চলে তো বটেই সারা বিশ্বেই পরিচিতি লাভ করেছিল। এসব ইতিহাস আজ কারও অজানা নয়।

আমরা জানি কোনো জাতি, কোনো ভূখ-, কোনো নগর একদিনে গড়ে ওঠে না। এর পেছনে থাকে হাজার বছরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। তেমনি করে চট্টগ্রাম নগরও একদিনে বা দুয়েক শ বছরে গড়ে ওঠেনি। এর পেছনেও আছে দীর্ঘকালের ইতিহাস। যেকোনো সভ্য জাতি তার ইতিহাস-ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করে উত্তর প্রজন্মের স্বার্থে। এক্ষেত্রে বাঙালি কিছুটা কৃপণ তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এই কৃপণতা ও দায়হীনতার কারণে আমরা অনেক ইতিহাসের স্মারক ও ঐতিহ্যকে হারিয়ে ফেলেছি ইতিমধ্যে। এখনও যদি আমরা সচেতন না হই তাহলে বাদবাকি চিহ্নগুলোও একদিন বিলীন হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। এই নগর তিলতিল করে কীভাবে, কাদের হাতে গড়ে উঠেছিল তা পরবর্তী প্রজন্মকে জানানো একটি নৈতিক দায়িত্বও বটে।

তেমন এক ইতিহাসের স্মারক কদম মুবারক মসজিদ। যা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৭২৩ সালে। এ বছর মসজিদটির তিন শত বছর পূর্ণ হলো। মোঘলরা সারা ভারত শাসন করলেও দক্ষিণ-পূর্বের এই অঞ্চলে শাসন পরিচালনায় বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে মগ তথা আরাকানি ও পর্তুগিজ দস্যুদের দ্বারা।

মুঘল সম্রাট মুহম্মদ শাহ এর শাসনামলে চট্টগ্রামকে আবার মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে আনার পর ১১৫৬ হিজরি বা ১৭২৩ সালে তাঁর নিযুক্ত ফৌজদার মুহম্মদ ইয়াসিন এ মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৭১৯ থেকে ১৭২৩ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ চার বছরে মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত হয়। মসজিদটি নির্মাণকালে মুঘল স্থাপত্যশৈলীকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যার কিছু নিদর্শন এখনো বিদ্যমান। মুহাম্মদ ইয়াসিন একসময় হজ করতে যান এবং ফেরার সময় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পদাঙ্কিত (কদম) একটি পাথর নিয়ে আসেন যেটি মসজিদের পাশে প্রদর্শনের জন্য ব্যবস্থা করেন। সে থেকে মসজিদটির নাম হয় কদম মুবারক মসজিদ। ১৭৬১ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আন্দরকিল্লা শাহি জামে মসজিদকে গোলাবারুদ রাখার গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করলে এই মসজিদে মুসল্লির সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে হামিদুল্লাহ খাঁ’র আবেদনের প্রেক্ষিতে আন্দরকিল্লা মসজিদটি মুসলমানদের জন্য আবারও উন্মুক্ত করার আগ পর্যন্ত কদম মুবারক মসজিদই ছিল ই এলাকার বড় মসজিদ।

মসজিদটি কয়েকবার সংস্কার ও স্থান সংকুলানের স্বার্থে বর্ধিতকরণ করা হয়েছে। তাতে মূল স্থাপনা অনেকটা আড়াল হয়ে পড়লেও এখনও অনেক কিছুই বিদ্যমান। আন্দরকিল্লা- জামালখান-ঝাউতলা মিলিয়ে বিশাল মহল্লার মানুষ এখানে জুমার নামাজসহ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। এই মহল্লার কবরস্থানও মসজিদের পাশে যেখানে মসজিদের নির্মাতা মুহাম্মদ ইয়াসিন শাহসহ চট্টগ্রামের অনেক বিশিষ্টজনের কবর রয়েছে। কয়েকবছর আগে কবরস্থানের সংস্কার করা হয়। পূর্বদিকে রয়েছে মসজিদের মূল ফটক। আরেকটি ফটক আছে মসজিদের উত্তরপাশে মোমিন রোডের সঙ্গে লাগোয়া।

মাননীয় মেয়র, এত বড় গৌরচন্দ্রিকার অবতারণা করতে হলো মসজিদটির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য যদিও আমি জানি একজন মুক্তিযোদ্ধা, লেখক ও শিল্পসচেতন ব্যক্তি হিসেবে এর সবকিছুই আপনার জানার কথা। কিন্তু একটি বিষয় আপনি জানেন না আর তা হলো ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটি নানাদিক থেকে অবহেলিত। প্রতিবেদনের সঙ্গে যুক্ত ছবিগুলো প্রমাণ করছে বর্তমানে এর চতুর্পাশের পরিবেশটি কেমন।

জায়গাটিকে পরিচ্ছন্ন রাখার সকল প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় আপনার শরণাপন্ন হতে হলো। স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কোনো এক রহস্যপূর্ণ কারণে এই এলাকার প্রতি চরম উদাসীন। বছরের পর বছর তাঁকে অনুরোধ করেও মসজিদের প্রবেশপথ থেকে আবর্জনার ভাগাড় সরানো যায় না। এমনকি মসজিদের সিঁড়ির গোড়ায়ও আবর্জনা জমে থাকে দিনের পর দিন।

পূর্বদিকের ফটক দিয়ে প্রবেশকালে কারও মনে হবে না এটি তিন শ বছর আগের একটি ঐতিহাসিক মসজিদ।

সিটি করপোরেশন যে সফলভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করতে পারে তা দেখিয়েছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি পারলে পরবর্তী মেয়রগণ কেন পারবেন না সে প্রশ্ন জনগণের। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটিকে টিকিয়ে রাখা, এর পরিবেশকে সুস্থ রাখার দায়িত্ব কতটুকু সিটি করপোরেশনের আর কতটুকু মসজিদ পরিচালনা কমিটির তা বোঝার ক্ষমতা আমার মতো সাধারণ মানুষের নেই তবে এটা বুঝতে পারি যে মসজিদটি অবহেলা ও অব্যবস্থাপনার একটি স্বচ্ছ দৃষ্টান্ত।