সমাজে সামগ্রিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটাতে হবে

সমাজে নানা ইস্যু নিয়ে নানাভাবে নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। এই নির্যাতন শারীরিক ও মানসিক দু’ভাবেই হচ্ছে। এই ধরনের অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিরোধে বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন কাজ করছে এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও কাজ হচ্ছে। কিন্তু এরপরও আমরা আসলে খুব একটা স্বস্তির জায়গা খুঁজে পাচ্ছি না।
এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতার কারণ, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিযার্তিত নারীদের আইনি সহায়তাসহ তাদের স্বাবলম্বী এবং অধিকার সচেতন হয়ে ওঠার নানা কার্যক্রমের কথা জানিয়েছেন মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক আতিয়া চৌধুরী

সাক্ষাতকার নিয়েছেন সুপ্রভাতের প্রধান প্রতিবেদক নিজাম সিদ্দিকী

সুপ্রভাত : আইনি কঠোরতা, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির নানা কার্যক্রম অব্যাহত থাকার পরেও আমাদের সমাজে নারীর প্রতি শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলছে। এর কারণ কী বলে মনে করেন?
আতিয়া চৌধুরী: নারীর প্রতি শারীরিক সহিংসতা হচ্ছে, মানসিক বিভিন্ন সহিংসতা হচ্ছে, যৌন সহিংসতা হচ্ছে এবং নানানভাবে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হচ্ছে নারীকে। এসবের সঙ্গে কারা জড়িত? এই সহিংসতাগুলো কারা ঘটাচ্ছে? আপনি যদি দেখেন এসব নারীর মেজরিটি পারসেন্ট থাকছে বাড়িতে। নারীকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে কারা? ভাই-বোন, বাবা-মা, হাজব্যান্ড বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন। আবার ধরেন, আমরা যখন নারীর প্রতি শারীরিক বা মানসিক নির্যাতনের কথা যদি বলি, তাহলে ওগুলো ঘটছে কোথায় ? তা-ও কিন্তু প্রথমত বাড়িতে স্বামীর দ্বারা, শাশুড়ির দ্বারা বা শ্বশুরবাড়ির অন্য লোকজনের দ্বারা। কখনো কখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে মেয়ে তার বাবার বাড়িতে, ভাই এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছে। নারীরা নিজের সব মর্যাদার জন্যও লড়াই করছে। আবার যে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, ফিজিক্যালি মার খাচ্ছে স্বামীর দ্বারা বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন দ্বারা গালিগালাজ অথবা বিভিন্ন ভাবে হিউমেন রিজেক্ট হচ্ছে সেই মেয়েরা আসলে এটার প্রতিকার চাইছে না। কেন চাইছে না? কারণ সে ভাবছে এতে সোসাইটির লোকজন তাকে ভালোভাবে গ্রহণ করবে না। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কঠোর আইনের শাসন থাকলেও সেই নির্যাতনের প্রতিকার মেলে না সব সময়ে। মেয়েরা যে মামলাগুলো করছে এই মামলাগুলো শেষ পর্যন্ত নানান কারণেই প্রমাণ করা যাচ্ছে না। পুলিশ হয়তো অপরাধীকে দ্রুত আইনের আওতায় আনে কিন্তু মামলা চালানোর জন্য সাক্ষী খুঁজে পাওয়া যায় না। এর কারণ হলো, বেশিরভাগ সময়ই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী পরিবারের কোনো সদস্য অথবা পাড়া-পড়শিরা হয়তো জানে ওই নারীর ওপর যা হয়েছে তা ঠিক হয়নি কিন্তু সামাজিক চাপ ও মানসিক সংকীর্ণতার কারণে সে সহায়তা করতে এগিয়ে আসে না। একটা পর্যায়ে দেখা গেল যে, বেশ কিছু মিথ্যা মামলাও হয়েছে, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলাও হয়েছে। তাহলে দেখেন সেখানেও একজন নারী নির্যাতনের শিকার। একজন নারীকে বাধ্য করা হয়েছে একটা মিথ্যা মামলা করতে তার পরিবারের লোকজন দ্বারা। আমার মনে হয়, এ বিষয়ে সমাজে একটি সামগ্রিক মূল্যবোধের পরিবর্তন ঘটাতে হবে। সেটা না হলে নারীর প্রতি নির্যাতন বন্ধ হবে না।

সুপ্রভাত: আপনারা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে নারীদের সহায়তা প্রদানে কী কী ব্যবস্তা নিয়ে থাকেন?
আতিয়া চৌধুরী: মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর মূলত নারীদের পরনির্ভরশীলতা কমানোর জন্য, তারা যেন উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সে জন্য বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। আমাদের চট্টগ্রাম অফিসে আমরা পাঁচটা ট্রেডে তিন মাস মেয়াদি ট্রেনিং করিয়ে থাকি। এগুলো হচ্ছে বিউটিফিকেশন, মোবাইল সার্ভিসিং, শোপিস তৈরি, ব্লক বাটিক অ্যান্ড অ্যামব্রয়ডারি, টেইলারিং। এখানে বিনামূল্যে তারা এটা শেখেন। উপরন্তু আমরা তাদের দৈনিক উপস্তিতির ভিত্তিতে যে যতদিন উপস্তিত থাকেন আমরা প্রতিদিনের জন্য ১০০ টাকা করে দিয়ে থাকি। আমাদের উপজেলাগুলোতে এবং জেলায়ও বিভিন্ন পর্যায়ে যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, তারপর এলাকা ভিত্তিক কিছু রেজিস্টার্ড মহিলা সমিতি আছে। ওই সমিতিগুলোর মাধ্যমে বিভিন্ন এনজিওর সহযোগিতায় আমরা বিভিন্ন জায়গায় উঠানবৈঠক করে থাকি। এতে বিভিন্ন ইস্যুতে অ্যাওয়ারনেস ক্রিয়েট এবং আমাদের সেবা কার্যক্রমগুলো সম্পর্কে অবগত করি। এর বাইরে বিভিন্ন উপজেলায় সোশ্যাল সেফটি নিড প্রোগ্রামের আওতায় কিছু প্রোগ্রাম আছে। আমরা সারা বাংলাদেশে ১০ লক্ষ নারীকে ভালনারেবল উইমেন বেনিফিট (ভিডাব্লিউবি) প্রোগ্রামের আওতায় সহায়তা করছি। এ প্রোগ্রামে বিধবা বা স্বামী পরিত্যক্তা ও কর্মক্ষম নারীদের প্রতিমাসে প্রায় ৩০ কেজি চাল দিয়ে থাকি। এতে তারা নিজস্ব একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলে, সে অ্যাকাউন্টে সে টাকা জমা করে, ইউনিয়ন পরিষদে মেমোটা দেখিয়ে ৩০ কেজি চাল সংগ্রহ করে। পাশাপাশি তাদেরকে অর্থ উপার্জন করার পথ তৈরি করে দিতে পারে এ ধরনের দক্ষতা অর্জনে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। আমাদের মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপজেলা অফিসগুলোতে ২৫ হাজার থেকে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ দিয়ে থাকি মাত্র ফাইভ পার্সেন্ট সার্ভিস চার্জে। যারা নারী উদ্যোক্তা হতে চায় সেসব নারীকে আমরা এই ঋণ সুবিধাটা দিয়ে থাকি। এর মধ্যে যেকোনো অ্যামাউন্টের টাকা ঋণ হিসেবে নিয়ে তারা চাইলে ছোট ছোট বিজনেস স্টার্ট করতে পারে। চিটাগাং সিটি কর্পোরেশনে নতুন একটা প্রোজেক্ট আমরা শুরু করতে যাচ্ছি। যেখানে ইউনিসেফ আমাদের সঙ্গে পার্টনারশিপ হিসেবে কাজ করবে। এর মাধ্যমে শহরের মধ্যে আমাদের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের বা”চাদেরকে নিয়মিত কিছু ট্রেনিং করানো হবে।

সুপ্রভাত : আপনারা নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কী ধরনের উদ্যোগ নিয়ে থাকেন?
আতিয়া চৌধুরী: সহিংসতার ঘটনায় নারী যদি কোন আইনি সহায়তা চায় সে ক্ষেত্রে আমরা তাকে আইনি সহায়তা পেতে সাহায্য করি। আমাদের চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে একটি ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার রয়েছে, সেখানে নারীদের জন্য কাউন্সিলিং-এর ব্যবস্তা রয়েছে। এটি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেওয়া হয়। নগরের মনসুরাবাদ পাসপোর্ট অফিসের পাশেই আমাদের মহিলা সহায়তা কর্মসূচি রয়েছে। কোন ভুক্তভোগী যদি সামাজিকভাবে নির্যাতনের ঘটনার নিষ্পত্তি চান, তাহলে সে ক্ষেত্রে সহায়তা করা হয়। এজন্য সেখানে আমাদের দুইজন কর্মকর্তা রয়েছেন। আইনি সহায়তা নিতে হলে মামলার কাগজপত্র সেখানে দাখিল করে আবেদন করতে হয়। কোন নারী যদি নির্যাতনের পর আশ্রয় ও কাজের সন্ধানে করেন তাহলে সেক্ষেত্রে ওই নারীকে ছয় মাস পর্যন্ত আশ্রয় ও জীবিকা নির্বাহের উপযোগী বিভিন্ন কাজের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রতিটি উপজেলায় আমাদের একটি করে ক্লাব রয়েছে, যেখানে ১০-২০ জন কিশোরীকে কারাতে, সংগীত ও আবৃত্তির পাশাপাশি ফার্স্ট এইড ট্রেনিং দেওয়া হয়ে থাকে।

সুপ্রভাত: এসব প্রোগ্রামের ক্ষেত্রে কি অনিয়ম হওয়ার কোন সুযোগ আছে?
আতিয়া চৌধুরী: এসবের কোথাও অনিয়ম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলেই আমার মনে হয়। কোথাও অনিয়ম হলে অনলাইন অভিযোগ প্রতিকার ব্যবস্তাপনায় অভিযোগ দিতে পারেন। আর সংশ্লিষ্ট উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কাছে দিতে পারেন, আমাদের জেলা কার্যালয়ে দিতে পারেন, আমাদের অধিদপ্তরে দিতে পারেন।

সুপ্রভাত : নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আমাদের কোন কোন বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আতিয়া চৌধুরী: আমাদের সোসাইটিতে সামগ্রিকভাবে মানুষের মাইন্ডসেটে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনার জন্য প্রত্যেকের রেসপন্সিবিলিটি নিতে হবে। একজন ব্যক্তি হিসেবে যদি আমরা এটাকে জিরো টলারেন্সের জায়গায় নিতে না পারি, আমার চোখের সামনে একজন নারীর ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটল। কিন্তু আমি ওটাকে ইগনোর করলাম। আমি নির্যাতনের সাক্ষী দিচ্ছি না। শাই ফিল করছি। ভাবছি যে আমার আত্মীয়ের বিরুদ্ধে আমি সাক্ষী দেবো, তার সঙ্গে আমার আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট হবে। এই জায়গাগুলো থেকে আমরা আসলে বেরিয়ে আসতে হবে। যে আমি আজকে এ থেকে বের হলাম না তাহলে একদিন আমাকেও একই পরিস্তিতির শিকার হতে হবে। এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। আরেকটা হচ্ছে, আমরা কোথাও নারী নির্যাতনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করলে সাথে সাথে টোল ফ্রি হেল্পলাইন নম্বরগুলোর জানিয়ে দিতে পারি। এতে আমাদের মোবাইল থেকে টাকাও খরচ হচ্ছে না। ওয়ান জিরো নাইন, ট্রিপল নাইন-এ ফোন করে যদি কোথাও বাল্যবিবাহের ঘটনা বা একজন নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনার মেসেজ দিতে পারি তাহলেও কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে ওখানে প্রশাসন একটু কাজ করতে পারবে। এই টোল ফ্রি হেল্পলাইন নম্বরগুলো ব্যাপারে প্রচার করা এবং এগুলো ব্যবহার করার জন্য মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে। আমরা কিন্তু এই প্রচারণাগুলো করছি। বিবাহ নিবন্ধনে উদ্বুদ্ধ করা মানুষকে। এনআইডির মাধ্যমে বিবাহ নিবন্ধন প্রক্রিয়াটাকে অনলাইন করা হলে, বহু বিবাহটা বন্ধ করা সহজ হবে। এতে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্তে বসে একজন বিবাহ নিবন্ধক, এনআইডি সার্চ করে দেখতে পাবেন বিয়েটা নিবন্ধন করা আছে কিনা। তাহলে কেউ নিজেকে অবিবাহিত বলে পরিচয় দিয়ে বিয়ে করার প্রতারণা করতে পারবে না। যেহেতু নারী নির্যাতনের মতো অপরাধগুলো পরিবারেই ঘটছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সেই ক্ষেত্রে পারিবারিক সচেতনতার জন্যে আপনার ছোট ভাই যদি তার ওয়াইফের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে তখন আপনি যদি তাকে প্রোটেক্ট করতে পারেন তার ওয়াইফের প্রতি অন্যায় করতে। আপনি নিজেকে যদি নিবৃত্ত করতে পারেন আপনার স্ত্রীর প্রতি অন্যায় করতে, আপনার বোনের প্রতি অন্যায় করতে তাহলে এক্ষেত্রে আমাদের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যাবে আশা করছি।