নিজস্ব প্রতিবেদক »
নগরীতে সরকার নির্ধারিত দামে মিলছে না চিনিসহ অন্যান্য পণ্যসামগ্রী। পাইকারি ও খুচরা উভয় বাজারে বেড়েছে চিনির দাম। নির্ধারিত দামের চেয়ে কেজিপ্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা অতিরিক্ত দামে বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে। একই সঙ্গে আটার দাম বাড়াতেই চালের দিকে ঝুঁকছে মানুষ। অন্যান্য বছর এমন মৌসুমে চালের দাম কমলেও এবার তা ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের দাবি, দেশের ১০ থেকে ১৫টি বড় কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার ব্যবস্থা।
খাতুনগঞ্জের চালের আড়ৎ ঘুরে দেখা যায়, ৫০ কেজি বস্তার ভারতীয় বেতি বিক্রি হচ্ছে ২১৮০ টাকা, থাই বেতি ২২৫০ টাকা, দেশি বেতি ২৬০০ থেকে ২৯৫০ টাকা, মিনিকেট ২৯৫০ থেকে ৩০৫০ টাকা। অন্যদিকে ২৫ কেজি ওজনের বস্তার নাজিরশাইল মানভেদে ১৩০০ থেকে ২১০০, কাটারি ১৪৫০ থেকে ১৫০০, চিনিগুঁড়া ৩৫০০ থেকে ৩৫৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ অন্যান্য বছর এমন দিনে বস্তায় আরো ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পাওয়া যেত বলে ব্যবসায়ীরা জানান।
নতুন চাক্তাইয়ের সাজ্জাদ ট্রেডার্সের চাল ব্যবসায়ী জামাল হোসেন সুপ্রভাতকে বলেন, ‘আটা-ময়দার দাম বাড়াতেই মানুষ চালের প্রতি ঝুঁকলেও এই পণ্যটিও সাধারণ লোকের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। আগের দিনে যে পরিমাণ চাল বিক্রি হতো তা এখন হচ্ছে না। চালের দাম কমবে কিভাবে, উৎপাদকরা এখন কর্পোরেট কোম্পানিদের নিয়ন্ত্রণে। শুধু চাল না, দেশের প্রায় পণ্যের বাজার তাদের দখলে চলে যাচ্ছে।’
চিনির বাজারে অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ
বৃহস্পতিবার নগরীর একাধিক বাজার ঘুরে দেখা যায়, চিনির বাজার অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বাজাওে চিনি কেজি ১১০ থেকে ১১৫ টাকা বিক্রি করছে। যা গত এক বছরের ৪৫ শতাংশেরও বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। গত ১৭ নভেম্বর কেজিতে ১৩ টাকা বাড়িয়ে প্যাকেট চিনির দাম ১০৮ টাকা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। পাশাপাশি নির্ধারিত দর অনুযায়ী প্রতিকেজি খোলা চিনির দাম পড়বে ১০২ টাকা। অথচ খুচরা দোকানগুলোতে খোলা চিনি কেজি ১১৫ থেকে ১২০ টাকার উপরে বিক্রি হচ্ছে।
খাতুনগঞ্জের আমদানিকারকরা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে পরিশোধিত চিনির আমদানি মূল্য প্রতিটন ৫৫০ ইউএস ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৭ হাজার ৭৫০ টাকা (প্রতি ডলার ১০৫ টাকা হিসাবে)। এ হিসাবে প্রতিকেজি চিনির আমদানি মূল্য ৫৭ দশমিক ৭৫ টাকা। বন্দরে কাস্টমস ডিউটি (সিডি কর) দিতে হয় ৬ হাজার টাকা, রেগুলার ডিউটি (আরডি) ৩০ শতাংশ, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ১৫ শতাংশ, অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) ৫ শতাংশ এবং সমন্বয় কর (এটি) ৫ শতাংশ দিতে হয়। সব মিলিয়ে প্রতিকেজি পরিশোধিত চিনিতে ৪০ টাকার মতো বিভিন্ন শুল্ক দিতে হয়। আবার অপরিশোধিত চিনির ক্ষেত্রে প্রতি কেজিতে বিভিন্ন কর দিতে হয় ৩৩ টাকার মতো। এ হিসাবে প্রতিকেজি চিনির দাম পড়ে ১০০ টাকার মতো। আমদানিকারক প্রতিমণ চিনি বিক্রি করছেন ৩ হাজার ৯০০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৯৫০ টাকা দরে। প্রতিকেজি চিনি বিক্রি করছেন আমদানিকারকরা ১০৬ টাকার বেশি দরে। আমদানিকারকরা প্রতিকেজি চিনিতে মুনাফা করছেন ৬ টাকা। এই চিনি খুচরা বাজারে মুদি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করছেন ১১৫ থেকে ১২০ টাকা দরে। হাতবদলের পর প্রতিকেজি চিনিতে মুনাফা করছেন ১২ থেকে ১৫ টাকা।
খুচরা চিনি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, চিনির আমদানিকারকরা সিন্ডিকেট করে চিনির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। পরিবহন খরচ বৃদ্ধি ও আমদানি খরচ বাড়ার অজুহাতে চিনির দাম লাগামহীনভাবে বাড়ানো হচ্ছে। সরকার বিদেশ থেকে জিটুজির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ চাল আমদানি করলেও চালের দামের ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। আবার কিছু কিছু মিলার সামনে আরও দাম বাড়বে এমন আশায় চাল মজুত করছে। ফলে চালের বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। মিল মালিকরা চালের সরবরাহ একেবারে কমিয়ে দিয়েছে। চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জে চালের আড়তের কয়েকজন বড় ব্যবসায়ীর কাছেও বিপুল পরিমাণ চাল মজুত রয়েছে। উত্তরবঙ্গের মিলারদের যোগসাজশে তারাও বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বাড়াচ্ছে। এ কারণে চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না।
কমছে পেঁয়াজের দাম
পেঁয়াজের বাজার তিন মাস স্থিতিশীল থাকার পর আরও কমতে শুরু করেছে। আগস্টের মাঝামাঝি ভারতীয় যে পেঁয়াজের দাম ৪০ থেকে ৪৫ টাকা ছিল তা কেজি প্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা কমে ৩১ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চাক্তাই আড়তদার ও ব্যবসায়ী সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফোরকান সুপ্রভাতকে বলেন, ‘ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি করা যাচ্ছে। এলসি করা যাচ্ছে। আমাদের দৈনিক এক ট্রাক মাল আসছে। বাজারে পেঁয়াজের চাহিদা আছে কিন্তু পেঁয়াজের বাজার স্থিতিতে না থাকাতেই লোকসানে বিক্রি করতে হচ্ছে। যে পেঁয়াজ আমরা বিক্রি করছি ৪২ থেকে ৪৫ টাকা তা এখন ৩১ টাকায় বিক্রি করছি।’
কমছে সবজি ও মাছের দাম, বেড়েছে মাংসের
নগরীতে শীতকালীন সবজির সরবরাহ বাড়াতেই দিন দিন কমতে শুরু করেছে সব ধরনের সবজির দাম। এতে ক্রেতাদের মধ্যে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেখা দিয়েছে। সবচেয়ে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে পুরাতন আলু ও পেঁপে। যা কেজিতে ১৮ থেকে ২০ টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে পর্যাপ্ত যোগান থাকায় আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে প্রায় সব মাছ, তবে যোগান স্বল্পতায় মাংসের দাম কিছুটা বাড়ছে। বৃহস্পতিবার নগরীর রিয়াজউদ্দিন ও বহদ্দারহাট বাজার এমন চিত্র দেখা যায়।
কাঁচামরিচ গত দু’মাস আগে কেজিতে বিক্রি হয়েছে ১২০ টাকায়, তা এখন ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একই অবস্থা শসার। প্রতি কেজি শসা বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকায়, যা গত মাসে ছিল ১২০ টাকা। পুরোনো আলু ১৮ থেকে ২০ টাকা, নতুন আলু ৪০, বেগুন ৩৫ থেকে ৪০ টাকা, পটোল ৪৫, শিম (উত্তরবঙ্গের) ৪০, চট্টগ্রামের শিম ৭০ টাকা। বরবটি ৫০, ঢ্যাঁড়শ ৫০, পেঁপে ২০, করলা ৪০ থেকে ৫০, উচ্ছে ৭০, মুলা ২৫, গাজর ৬০, টমেটো ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে।
এ ছাড়া প্রতিটি লাউ ৫০, ফুলকপি ২০ থেকে ৩০, বাঁধাকপি ২৫ থেকে ৩০ ও লালশাক প্রতি আঁটি ১০ থেকে ১৫ টাকা, মূলাশাক প্রতি আঁটি ১০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। গত সপ্তাহের চেয়ে কেজি প্রতি ১০ টাকা কমে সবজি পাওয়া যাচ্ছে। লেবু প্রতি ডজন ৩০ টাকা এবং কাঁচাকলা প্রতি হালি ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কাজির দেউড়ি বাজারে দেখা যায়, এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতিটি মাছের দাম কমতে শুরু করেছে। যে কাচকি মাছ বিক্রি হয়েছে ৭০০ টাকা কেজি দরে, তা এখন ৪০০ টাকা ধরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া আগের দামে ফিরেছে রুই মাছও। প্রতি কেজি বড় সাইজের রুই বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা। বাগদা চিংড়ি ৭০০ ও গলদা ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এর বাইরে আইড়, চিতল, বেলে মাছ আকারভেদে প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৬০০ থেকে ৮০০ টাকায়। পুঁটি ২২০ টাকা, কাতল ৪০০, শিং ৪৫০, টাকি ৪৫০, কই ৬০০, চিংড়ি ৮০০ থেকে ১০০০, রূপচাঁদা ৭০০ থেকে ৯০০, বোয়াল ৬৫০ থেকে ৭০০, এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ১১০০ এবং এক কেজির কম ওজনের ইলিশ ৮৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কোরাল ৮০০, সুরমা বড় ৯৫০, বোল ৫৫০, লইট্টা ২২০, পোয়া ৩৫০, পাবদা ৪০০, পাঙ্গাস ২২০, টেংরা ৫৫০ ও লাল কোরাল ৬০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকা কেজি। খাসির মাংস ৮৫০ থেকে ৯০০ টাকা। আগের সপ্তাহে উভয়ই কেজিতে ৫০ টাকা কম ছিল। গরু ও খাসির সঙ্গে বাড়ছে মুরগির মাংসের দামও। ব্রয়লার মুরগি ১০ টাকা বেড়ে বর্তমানে ১৪৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ডিম (লেয়ার) ডজন ১১০ টাকা, হাঁসের ডিম ১৯৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে।