রুশো মাহমুদ >>
আমেরিকা, বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর রাষ্ট্র। সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বহুজাতিক সমাজ ব্যবস্থারদেশ। নানা দেশ নানাজাতির অভিবাসীতে ভরা হরেক সংস্কৃতির এক মিলনক্ষেত্র আমেরিকা। ৩৩ কোটি জনঅধ্যুষিত এই দেশের নির্বাচন ব্যবস্থা বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পদ্ধতি কিছুটা জটিল এবং পরোক্ষ। আজ নির্বাচন, সারা দুনিয়ার চোখ এখন আমেরিকার দিকে।
হোয়াইট হাউজে কে যাবেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প না জো বাইডেন? আজ সিদ্ধান্ত দেবেন আমেরিকানরা। ফলাফল কী হবে বা কী হতে পারে ধারণা করাই মুশকিল। আমেরিকার নির্বাচনে জরিপ বা ট্রেন্ড দেখে ফলাফল আঁচ করা বড়ই দুরূহ।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার জন্য জনগণের ভোট, যা পপুলার ভোট হিসেবে পরিচিত। সেই পপুলার ভোট বেশি পাওয়াটা একমাত্র বিষয় না। এর পরিবর্তে প্রার্থীরা বরং ইলেক্টোরাল কলেজে বেশি ভোট পাওয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকেন।
ইলেকটোরাল কলেজ কী?
আমেরিকার সংবিধানের ২ নম্বর ধারা অনুসারে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয় ইলেকটোরাল কলেজের মাধ্যমে। আমেরিকার কংগ্রেস দুই কক্ষবিশিষ্ট। জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে উচ্চ কক্ষ সিনেটের ১০০ সদস্য এবং নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন সদস্য নির্বাচিত হয়। এই প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ জন, সিনেটের ১০০ জন এবং ওয়াশিংটন ডিসি থেকে আরও ৩ জন মোট ৫৩৮ জনের সমন্বয়ে হয় ইলেকটোরাল কলেজ। কোন প্রার্থীকে জয়ী হতে হলে কমপক্ষে ২৭০টি ইলেকটোরাল ভোট পেতে হয়। অঙ্গরাজ্যে যে প্রার্থী বেশি পপুলার ভোট পান, সে রাজ্যে তার মনোনীত ইলেকটোরাল কলেজের সবাই জিতলেন বলে বিবেচিত হন। জনসংখ্যার অনুপাতে প্রতি রাজ্যের জন্য ইলেকটোরাল ভোট নির্ধারণ করা হয়।
নির্বাচনে একজন ভোটার নিজের পছন্দের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে ভোট দিলেও মূলত ভোটাররা ইলেকটোর নির্বাচনের জন্যই ভোট দেন। আর ইলেকটোরদের ভোটেই নির্বাচিত হয় আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। তাই দেখা যায় পপুলার ভোট বেশি পেয়েও কেউ প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হতে পারেন না। যেমনটা আমরা দেখি ১৮২৪, ১৮৭৬, ১৮৮৮, ২০০০ এবং ২০১৬ সালের নির্বাচনে। ২০০০ সালের নির্বাচনে ইলেকটোরাল ভোট কম পাওয়ায় ডেমোক্রেট প্রার্থী আল গোর রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশের চেয়ে ১০ লাখ বেশি পপুলার ভোট পেয়েও নির্বাচিত হতে পারেননি। একইভাবে ২০১৬ সালের নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইলেকটোরাল ভোট বেশি পাওয়ার কারণে ডেমোক্রেট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনের চেয়ে ৩০ লাখ পপুলার ভোট কম পেয়েও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন।
দুই দলের নির্বাচন
আমেরিকার রাজনীতি মূলত ডেমোক্রেট ও রিপাবলিকান দলকে ঘিরেই আবর্তিত।ডেমোক্রেটদের নির্বাচনী প্রতীক গাধা আর রিপাবলিকানদের প্রতীক হাতি। রিপাবলিকানরা কনজারভেটিভ, তারা কর্পোরেট ও বিজনেস মেগনেটদের স্বার্থ বেশি দেখেন। ডেমোক্রেটিক পার্টি তুলনামূলক লিবারেল, তারা বহুত্ববাদে বিশ্বাস করে, অভিবাসী ও ছোট জাতিগোষ্ঠীর প্রতি সহানুভূতিশীল, দরিদ্র ও মধ্যবিত্তদের স্বার্থের ব্যাপারেও অধিক যত্নবান ও সংবেদনশীল।
রেড স্টেট বনাম ব্লু স্টেট
আমেরিকার অঙ্গ রাজ্যগুলোকে নির্বাচনের সময় বেশিরভাগই রঙ দিয়ে চেনা যায়। রঙ বলে দেবে তারা একটি দলের পক্ষে। রিপাবলিকান দলের সমর্থন বেশি যেসব রাজ্যে সেগুলো লাল এবং ডেমোক্রেট দলের প্রাধান্য যেখানে সেসব নীল। ব্লু ও রেড জোনে জোরালো প্রচারণা চলে না। কারণঐতিহাসিকভাবেই নিজ নিজ দলের বাঁধা ভোট সেই রাজ্যগুলোতে।
ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট
সাধারণত বেশিরভাগ রাজ্যেই সবসময় একই রকমের ভোট পড়ে। কিছু কিছু রাজ্য আছে যেখানে দুজন প্রার্থীর যে কেউ বিজয়ী হতে পারেন। এসব রাজ্যেই নির্ধারিত হবে কে নির্বাচনে জয়ী আর কে পরাজিত হবেন। জয় পরাজয়ের যুদ্ধটা হয় সেখানেই আর তাই এসব রাজ্যকে বলা হয় ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট।
২০২০ এর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে যে রাজ্যগুলোকে ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেট হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট রয়েছে টেক্সাস রাজ্যে। এই রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোট ৩৮। উল্লেখযোগ্য ব্যাটলগ্রাউন্ড স্টেটগুলো হচ্ছে মিশিগান, আইওয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, পেনসিলভেনিয়া, জর্জিয়া,ফ্লোরিডাও অ্যারিজোয়ানা।
দুই প্রবীণের প্রথম হওয়ার লড়াই
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেকে সব বিষয়ে প্রথম দেখতে পছন্দ করেন। নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক প্রার্থী জো বাইডেনও ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে প্রথম হওয়ার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
এবারের নির্বাচনে জিতলে ৭৪ বয়সী ট্রাম্প আবারও প্রথম হওয়ার সুযোগ পাবেন। তিনি যদি জিতে যান তাহলে আবারও আমেরিকার প্রথম বয়স্ক প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হবেন। পরপর দুই দফা জনপ্রিয় ভোটে পিছিয়ে থেকেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে নিজেকে প্রথম হিসেবে দাবি করতে পারবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর নির্বাচনে যদি ৭৭ বয়সীজো বাইডেন জয়ী হন, তাহলে তাঁর জন্যও বেশ কিছু রেকর্ড অপেক্ষা করছে। জয়ী হলে বাইডেনও সবচেয়ে বেশি বয়সের আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিষিক্ত হওয়ার রেকর্ড করবেন।
জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে, তিনিই হবেন প্রথম কোন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট, যিনি ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টকে পরাজিত করে নির্বাচিত হবেন।
আগাম ভোটে রেকর্ড
নির্বাচনে এরই মধ্যে ৯ কোটিরও বেশি আগাম ভোট পড়েছে। নির্ধারিত তারিখের আগেই এত বিপুল সংখ্যক মানুষের ভোট প্রয়োগের ঘটনা দেশটিতে একশ বছরের মধ্যে রেকর্ড গড়েছে। শনিবার পর্যন্ত যে পরিমাণ আগাম ভোট পড়েছে, তা ২০১৬ সালের নির্বাচনে মোট ভোটের প্রায় ৬৫ শতাংশ।
চার বছর আগে ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৩ কোটি ৮০ লাখ ভোট পড়েছিল। এবার তা ছাড়িয়ে যেতে পারে। গত নির্বাচনে আগাম ভোট পড়েছিল ৪ কোটি ৭০ লাখ। এবার তা দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
ভোটের নানা অংক কষে শেষ পর্যন্ত হোয়াইট হাউজে কে যাচ্ছেন তা জানতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। আমেরিকায় গণনা হয় ভোটের দিনই। চূড়ান্ত ফলাফল জানতে মধ্যরাত বা বড়জোর পরের দিন পর্যন্ত লাগতে পারে। অপেক্ষা সে পর্যন্ত।