নিজস্ব প্রতিবেদক »
নগরে সক্রিয় রয়েছে একাধিক ছিনতাইকারী চক্র। মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ে টার্গেটে রয়েছে বিভিন্ন স্পট। এসব স্পটে ছিনতাইয়ে জড়িত চক্রের শতাধিক সদস্য। ছিনতাইয়ের এসব ঘটনায় থানায় অভিযোগ করা হলেও পুলিশ এসব ঘটনা তেমন গুরুত্ব নিয়ে দেখে না বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
জানা যায়, বিভিন্ন মার্কেট এলাকা, চলন্ত গাড়ি ও যেসব স্থানে মানুষের আনাগোনা কম সেসব স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি। এছাড়া যেসব জায়গায় মানুষের জটলা বেশি, সেখানে দুর্বৃত্তরা মূহূর্তের মধ্যে হাতিয়ে নিচ্ছে মোবাইল ফোন। মানুষ বুঝতে পারে না তার ফোন, ম্যানিব্যাগ খোয়া গেছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো নতুন ব্রিজ এলাকা। এ এলাকায় প্রতিদিন হাজারো মানুষের যাতায়াত থাকে বিভিন্ন গন্তব্যে। আসা-যাওয়ার তাড়াহুড়োয় থাকে মানুষ। এ সুযোগটা কাজে লাগায় দুর্বৃত্ত চক্র।
ওই এলাকায় প্রতিদিন কারও না কারও মোবাইল, মানিব্যাগ খোয়া যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ভুক্তভোগী এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ দায়ের করেন না। বলা যায় মোবাইল ও মানিব্যাগ হারানোর অন্যতম হট স্পট এ নতুন ব্রিজ এলাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক জানান, গত ২২ মার্চ তার পকেট থেকে আট হাজার নিয়ে গেছে ‘দুর্বৃত্তদের চক্র’। এছাড়া আরেক শিক্ষক জানান, তার কেনা নতুন মোবাইল ফোন কিভাবে প্যান্টের পকেট থেকে নিয়ে গেছে, তিনি বুঝতে পারেননি। তারা দুজনের কেউ থানায় অভিযোগ করেননি।
তাছাড়া মোটরসাইকেল বা প্রাইভেটকারে এসে ছিনতাইকারীরা মহিলাদের ভ্যানিটি ব্যাগ, রিকশাযাত্রীদের মোবাইল ফোন সেট, মানিব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনাও ঘটছে। গণপরিবহনে বেশি সক্রিয় দুর্বৃত্তরা।
১৮ মার্চ রাতে বাকলিয়া থানার শাহ আমানত ব্রিজ এলাকায় মোবাইল ছিনতাইয়ের শিকার পটিয়ার ব্যবসায়ী শফিকুর রহমান বলেন, বাসে জানালার পাশে বসেছিলাম। হঠাৎ জানলার পাশ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে ঐ স্থানের দায়িত্বরত দুজন পুলিশকে জানালে তারা থানায় যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।
নিউ মার্কেট মোড় এলাকায় রিকশা থেকে মোবাইল ছিনতাইয়ের শিকার হওয়া মো. আলতাফ হোসেন বলেন, ১৬ মার্চ রাতে রেয়াজউদ্দিন বাজার থেকে মালামাল কিনে রিকশায় করে ফিরিঙ্গী বাজার যাচ্ছিলাম। এ সময় হাত থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পাশে দাঁড়ানো এক পুলিশকে বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, মোবাইলের বক্স ও তথ্যাদি নিয়ে থানায় যেতে। আমার কাছে বক্স বা আইইএমআই কোড জানা ছিল না। তাই থানা কোনো অভিযোগ গ্রহণ করেনি।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রভাবশালী না হলে প্রতিকার পাওয়া যায় না।
ভুক্তভোগী আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের শিকার ভুক্তভোগীরা মামলা বা সাধারণ ডায়েরি করতেও থানায় যেতে আগ্রহ দেখান না। কারণ দামি ফোন না হলে পুলিশ তেমন গুরুত্ব দেয় না বলে অভিযোগ আছে। তবে স্মার্টফোন হাতছাড়া হলে সেটি ব্যবহারকারীদের জন্য ঝুঁকি তৈরি করে। ছবি ছাড়াও ইদানিং ব্যাংকিং পাসওয়ার্ডসহ সংবেদনশীল অনেক তথ্য মানুষ ফোনে রাখে, সেগুলো বেহাত হলে তৈরি হয় নিরাপত্তা ঝুঁকি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নগরীরতে ছিনতাইপ্রবণ হিসেবে কোতোয়ালী থানার লাভ-লেন থেকে নেভাল অ্যাভেনিউ, এমএ আজিজ স্টেডিয়াম থেকে সিআরবি কাঠের বাংলো, টাইগারপাস মোড় থেকে কদমতলী, ডিসি হিল থেকে রাইফেল ক্লাব, শহীদ মিনার এলাকা, সার্সন রোড, আসকার দীঘির পাড় থেকে গণি বেকারি মোড়, রহমতগঞ্জ ও বাকলিয়া থানার কালামিয়া বাজার, রাজাখালী, কর্ণফুলী নতুন ব্রিজ, পুরাতন ফিশারি ঘাট, নতুন ফিশারি ঘাট এলাকাসহ শতাধিক এলাকা চিহ্নিত রয়েছে পুলিশের।
এছাড়া নিউমার্কেট, বিআরটিসি মোড় এলাকায় মোবাইল ছিনতাইকারীরা সক্রিয়। চকবাজার থানার কলেজ রোড, খুলশী থানার জাকির হোসেন রোড, আমবাগান এলাকা, পতেঙ্গা থানার কাঠগড়, হালিশহর থানার বড়পোল এলাকা, বায়েজিদ বোস্তামী থানার মুরাদপুর অক্সিজেন রোড, ষোলশহর-বায়েজিদ বোস্তামী সড়ক এলাকায়ও নিয়মিত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে।
সূত্র জানায়, নগরীর জলসা মার্কেট, সিডিএ মার্কেট, শাহ আমানত মার্কেটে সক্রিয় থাকা একাধিক চক্রের হাতে রয়েছে আইএমইআই নম্বর পরিবর্তনের মেশিন। চুরির সঙ্গে জড়িতরা মোবাইল ফোন নিয়ে তাদের কাছে গেলে ৫০০ টাকা থেকে হাজার টাকার বিনিময়ে কয়েক মিনিটের মধ্যে আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে দেয়। আবার দামি আইফোন ও অন্যান্য দামি মোবাইল ফোন হলে নম্বর পরিবর্তনে ৩ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান জোরদার হলে চক্রটি নিজেদের আড়াল করতে চলে গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। সেখানে যন্ত্র বা মেশিন বসিয়ে চোরাই মোবাইল ফোনের আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করছে। আর এ ধরনের মোবাইল তারা ছড়িয়ে দিচ্ছে বাজারে। অনেকে না বুঝে চোরাই মোবাইল ফোন কিনে পরে হয়রানির শিকার হন।
তবে কোন কোন ব্যবসায়ী আইনি ঝামেলা এড়াতে চোরাইকৃত মোবাইলের ব্যবসার ধরন পাল্টিয়েছে।
নগরীর রেয়াজউদ্দিন বাজার, শাহ আমানত মার্কেট, জলসা মার্কেট, সিঙ্গাপুর মার্কেটেরসহ বেশ কিছু মার্কেটের কিছু দোকানে মিলছে অরজিনাল মোবাইলের যন্ত্রাংশ। ক্রেতাদের কাছে এসব যন্ত্রাংশ চড়া দামে বিক্রি করা যায়। যার ফলে আইএমইআই ঘটিত ঝামেলা থেকে নিজেদের এড়ানো যায় বলে জানা যায়।
মোবাইলের মূল যন্ত্রাংশ কিভাবে এত সহজলভ্যে পাওয়া যায় বা সংগ্রহের উৎসটি কি এমন প্রশ্নে রেয়াজউদ্দিন বাজারের এক মোবাইল ব্যবসায়ী বলেন, বিভিন্ন ব্যক্তিরা তাদের নষ্ট মোবাইল বিক্রি করলে আমরা তা কিনে যন্ত্রাংশগুলো সংগ্রহ করি। কিন্তু চোরাই কি’না এসব আমরা কিভাবে জানবো। এটি তদারকির দায়িত্ব প্রশাসনের।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা যায়, চোরাই মোবাইল ছিনতাইয়ের সাথে জড়িতদের ধরতে এক অভিযানে ২৩ মার্চ রাতে নগরীর খুলশী থানার নাসিরাবাদ এলাকা থেকে মো. সজিব ইসলাম (২৩) ও মো. শহিদুল ইসলামকে (২৩) নামের দুই সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে আরেকটি অভিযানে রেয়াজউদ্দিন বাজার ও বায়েজিদের অক্সিজেন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৯৫টি চোরাই মোবাইলসহ সংঘবদ্ধ ছিনতাই চক্রের ৭ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে মহানগর গোয়েন্দা (উত্তর) বিভাগ।
ছিনতাইয়ের স্বীকার হওয়া ভুক্তভোগীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে সিএমপির মহানগর গোয়েন্দা বিভাগ (উত্তর) উপ-পুলিশ কমিশনার নিহাদ আদনান তাইয়ান বলেন, আমাদের কাছে কেউ ছিনতাইয়ের অভিযোগ করলে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি। এ ছাড়া জাতীয় জরুরি সেবা ট্রিপল নাইনে (৯৯৯) কল করেও এ সেবা পাওয়া যাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, বেশ কয়েকটি অভিযানে গ্রেফতারকৃতদের সাথে কথা বলে জানতে পারি, তারা বিশেষ করে মোবাইলগুলো সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকা থেকে আনেন। আর দেশের ছিনতাই মোবাইলগুলো ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে পাচার করেন। যার ফলে এসব মোবাইল মালিকদের শনাক্ত করতে একটু সমস্যা হয়। এসব ঘটনায় সক্রিয় রয়েছে বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র। এসব চক্রে পেশাদার ছিনতাইকারীদের পাশাপাশি উঠতি বয়সী কিছু কিশোর ও তরুণরা ঝুঁকছে। তাছাড়া চক্রের সদস্যরা চোরাই মোবাইল ফোনের ইন্টারন্যাশনাল মোবাইল ইকুইপমেন্ট আইডেনটিটি-আইএমইআই নম্বর পরিবর্তন করে ফেলেন। এতে পরবর্তী সময়ে চোরাই মোবাইল ফোন শনাক্ত করতে সমস্যা হয়। তবে এসব ছিনতাইকারীরা আইএমইআই পরিবর্তন করলেও আমরা বিভিন্ন প্রযুক্তির সাহায্যে মোবাইলের মালিকদের শনাক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছি।