এস এম মারুফ »
করোনা সংক্রমণ রোধে আজ থেকে দেশে ‘সীমিত লকডাউন’ শুরু হয়েছে। বন্ধ গণপরিবহন, বন্ধ সব ধরনের মার্কেট। চলছে অফিস, চলছে রিকশা। পহেলা জুলাই থেকে সব বন্ধ। ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ আসছে, এরকম বার্তাই দিয়েছে সরকার।
করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহতা বিবেচনায় আর কিইবা করার আছে। দেশের ৪৪টি জেলা উচ্চ স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে, ১৩টি ঝুঁকিপূর্ণ এবং সাতটির অবস্থা মোটামুটি বলা হচ্ছে। এই অবস্থায় জানমালের নিরাপত্তা বিবেচনায় বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীকে ঝুঁকিমুক্ত রাখার কৌশল হিসেবে দেশজুড়ে এই লকডাউন এর বিকল্প ছিল না। যদিও জনজীবনে এই স্থবিরতার কারণে বিভিন্নমুখী প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সংকুচিত হবে, মানুষ কাজ হারাবে। বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের প্রান্তিক সীমা বদল হবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আগামী দিনগুলোতে করোনার সঙ্গেই বসবাস করতে হবে। পশ্চিমা বিশ্ব মোটামুটি টিকা নিয়ে সুরক্ষিত। করোনা প্রথমে কিন্তু ধনীর বাড়িতেই হানা দিয়েছিল। সুবিধা করতে না পেরে এখন গরিবালয়ে। গরিবের স্বভাব খারাপ। যতটা না তাকে অন্যে মারে, তার চেয়ে বেশি নিজে মরে। গরিবের কাজ কেবল গীবত করা। কার থেকে কি পেলাম আর কি পেলাম না সারাক্ষণ তার হিসাব করা।। নিজে কি করতে পারলাম সে হিসেবের ধারে কাছেও নেই। আল্লাহ্ কাউকে গরিব বানায় না, সে নিজে গরিব হয়। এরপর তার প্রতিদিনকার কাজ সৃষ্টিকর্তাকে দোষারোপ করা। অথচ হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে সামান্য সচেতনতায় দারিদ্র্যের তীব্রতা অনেকটাই কমে আসে।
২০১৯ সালের শেষ দিকে যখন করোনার প্রকোপ শুরু হয় তখন থেকেই সবাই জানতো এই মহামারী দীর্ঘস্থায়ী হবে। আগামীর পৃথিবীকে করোনার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে চলতে হবে অনেকদিন। মানবজাতির সামনে এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে গবেষণার জন্য প্রায় ৭৫০ কোটি ইউরোর প্রয়োজন হবে, এমনটাই ধরে নেওয়া হয়েছিল ইইউ’র পক্ষ থেকে। টিকা আবিষ্কার হওয়া পর্যন্ত নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি ও আরও ভালো পরীক্ষার ব্যবস্থা করতেও এই অর্থ ব্যয় হবে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস বলেছিলেন, সব মানুষের হাতে এই গবেষণার সুফল পৌঁছে দিতে এই অঙ্কের পাঁচ গুণ প্রয়োজন হতে পারে।
বোঝাই যাচ্ছে সারা পৃথিবী করোনার সঙ্গে লড়তে সেই তখন থেকেই আটঘাট বেঁধে নেমেছে। আমরা তারও অনেকটা সময় পর, যখন আক্রান্ত হলাম, ২৪ মার্চ, ২০২০ এসে লকডাউন দিলাম। সেই থেকে লকডাউন, সেমিলক ডাউন, বিভিন্ন নামে ঐ এক জিনিসই চলছে। এখন পর্যন্ত করোনা মোকাবেলায় আমাদের কাছে ওই ডাউন সিনড্রোমই ভরসা। মাঝে কিছু মানুষ টিকা দিয়েছে, কেউ আবার একটা দিয়ে পরেরটা দিতে পারেনি। টিকা নিয়ে এককথায় লেজেগোবরে অবস্থা। এখন দেশে আছে শুধু অল্পকিছু উপহারের টিকা। কেনা টিকার মজুদ শূন্য প্রায়।
ইউরোপ আমেরিকা চীন রাশিয়া ওরা গবেষণা করবে। টিকা তৈরি হবে, আমাদের দেবে, আমরা বেঁচে থাকব। টিপিক্যাল দারিদ্র ভাবনা।
শুধু টিকা নয়, করোনা রোগের উপশম ও নিরাময়সহ সকল গবেষণা কাজের জন্য দুবছর আগে ইইউ’র বাজেট ছিল ৭৫ বিলিয়ন ইউরো। দেখুন এই মুহূর্তে বাংলাদেশের ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। চাইলে বাংলাদেশ নিজে অথবা সহযোগী কয়েকটি দেশের সাথে ইইউ’র মতো গবেষণার কাজ করতে পারতো। বাস্তবতা হলো আমরা কিছুই করিনি। কোনো উদ্যোগও নেই নি।
জনবহুল বাংলাদেশের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে জটিল। সফল ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ হলো আত্মবিশ্বাস অর্জন। এই জায়গাটায় বাংলাদেশ বরাবরের মতোই ভুগেছে।
আমরা কেউ আমলেই নিই না যে এই ব-দ্বীপের মানুষ পাটের জিনোম সিকুয়েন্স আবিষ্কার করেছে। লেটেস্ট ধরনের অ্যান্টিবায়েটিক তৈরি করেছে এখানকার বিজ্ঞানীরা। কেউ বিশ্বাসই করিনা এখানে কার্যকর রেপিড টেস্ট কিট আবিষ্কার হতে পারে। এখানে হবে টিকার গবেষণা? আরে ভাই, স্পষ্ট করে বলছি, ভাইরোলজিস্ট এর বেতন মেসির ধারে কাছেও নেই। না হয় মেসির বেতন দিয়েই দু-একজন ভাইরোলজিস্ট পুষতে দোষের কি আছে? চোর বাটপারদের কথা বাদই দিলাম, কেবল হ্যাকাররা যদি এই দেশের শত শত কোটি টাকা গিলে ফেলতে পারে, গবেষণার নামে বিজ্ঞানীর পিছনে না হয় নষ্টই হলো আরো কিছু টাকা। সরকার কেবলমাত্র গার্মেন্টস সেক্টরের জন্য সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছে, গবেষণার জন্য সাড়ে পাঁচশ টাকাও দেয়নি। এখন আমরা নিশ্চয়ই সকলেই বুঝতে পারছি, বিষয়টা মাইন্ড সেটের। সবকিছুর আগে আমাদের মনোজগতে পরিবর্তন হতে হবে।
আমাদের বুঝতে হবে, করোনার পর আমরা এক পরিবর্তিত পৃথিবীতে বাস করছি। এখানে খাপ খাইয়ে নিতে হলে, টিকে থাকতে হলে, পরিবর্তিত ভাবনার বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে। না হলে কপালে দুঃখ আছে। এভাবে টাকা দিয়েও টিকা মিলবে না। কোভিড খেয়ে বেঘোরে প্রাণ দিতে হবে। এমনি করিয়া জগৎ জুড়িয়া মার খাইবে কি দুর্বল?
আমরা গবেষণায় মনোযোগী হলাম না, গবেষণায় কারো সঙ্গী হলাম না। আকাশের পানে তাকিয়ে থাকলাম। সিনোফার্মা’র টিকাকে বলা হয়ে থাকে বর্তমান দুনিয়ার সেরা ব্র্যান্ড। আমরা সিনোফার্মা’র ট্রায়ালের অনুমোদনই দিলাম না। আমরা বন্ধুরে টাকা দিলাম। তারপর নিশ্চিন্ত মনে ঘরে এসে বসে থাকলাম। টিকা ঘরে চলে আসবে। আমরা ভুলেই বসেছি আগের পৃথিবী আর নেই। এখন যা হবার তাই হচ্ছে।
ভারত আমাদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে, ঠিক আছে। আমাদের স্বাস্থ্য সমস্যাও ভারতই নিরসন করবে, যদি টিকা লাগে তাও। দেড়শ কোটি মানুষের দেশ ভারত। মহামারীর এই দিনে ভারতের উপর এমন নির্ভরতা কি ঠিক হলো? ভারতের সমস্যা আঞ্চলিক মোড়লিপনার, আমাদের সমস্যা বাঁচা-মরার।
সিনোফার্মার টিকা খুব ভালো একথার মানে এই নয়, চীনের কোলে উঠে বসে থাকলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। চীনা মধু যে খেয়েছে সেই জানে এই মধু কত মিষ্টি আর কত তেতো। চীনের সেরা বন্ধু পাকিস্তান কিনা জানিনা, তবে পাকিস্তানের সেরা বন্ধু কিন্তু চীন। সেই পাকিস্তানকে ঋণের ফাঁদে আটকে এখন নাকে দড়ি দিয়ে যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে ঘুরাচ্ছে। ১০ ডলারের সিনোফার্মার টিকা পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করেছে ২৭ ডলারে। আর চীনের ঋনের ফাঁদে আটকা শ্রীলংকার কাছে বিক্রি করেছে ১৫ ডলারে। চীনারা ব্যবসা ভালো বোঝে। আমাদের চীনের সঙ্গে ব্যবসা করতে হবে মগের মাপ বুঝে। মাপ না বুঝলে সে মগ উপচে ঢেলে দেবে। ১ মগ ঢেলে ৪ মগ এর পয়সা নেবে। বাড়তি তিন মগের পয়সা উপচে পড়ার জন্য। উপচে পড়াটুকু তো আর মাপতে পারছি না। নাক বোঁচা যা বলে তাই মানতে হবে।
চীনের সাথে টিকা নিয়ে কথা হবে। কিন্তু এক ব্যবসার সাথে অন্য ব্যবসা, ব্যবসার সাথে রাজনীতি জুড়তে দেয়া যাবে না। ব্যবসা হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। ব্যবসার পাকিস্তানি মডেল অরুণাচলের উত্তরে রেখে আসতে হবে। বাংলাদেশের দৃষ্টি হতে হবে সুদূর প্রসারী ব্যবসার ক্ষেত্রে হার্ড নেগোশিয়েটর হতে হবে। বর্তমান বিশ্বে নতুন মারণাস্ত্রের নাম টিকা। টিকা নিয়ে যা চলছে, পুরোটাই ব্যবসা।
টিকা নিয়ে গবেষণা ও উৎপাদনের জন্য সরকারকে সহযোগিতার হাত নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে প্রথম। ২৭ জুন, রবিবার সংবাদমাধ্যমের খবর, সরকার গোপালগঞ্জে এসেন্সিয়াাল ড্রাগস ফ্যাক্টরিতে টিকার উৎপাদন ও গবেষণার ব্যবস্থা করবে। সেখানে অবকাঠামো আছে, বর্ধিতাংশ নির্মাণ করে তৈরি হতে আরো বছর তিনেক সময় লেগে যাবে। খবরের মূল নির্যাসটুকুতে আশাবাদী হওয়ার কারণ তো আছেই, সরকার দেশেই টিকার গবেষণা ও উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে চায়। সেখান থেকে উৎপাদন হয়তো হতে পারে, কিন্তু টিকার গবেষণা একটি ইনটেনসিভ বিষয়। আমি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে এ জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান মনে করি। সেনাবাহিনীর অধীনে উচ্চশিক্ষার বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে। সেনাবাহিনীর মেডিক্যাল ফ্যাকাল্টির অধীনে বেশকিছু মেডিক্যাল কলেজ পরিচালিত হয়। তাদের জিম্মায় একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা গেলে ভালো হতো। পৃথিবীর দেশে দেশে সামরিক বাহিনীর অধীনে গৃহীত টিকা গবেষণার ফলাফল এককথায় মানবসভ্যতায় নজিরবিহীন অবদান রেখেছে গত শতাব্দি জুড়ে।
গবেষণার জন্য ব্যয় হবে শত সহস্র কোটি টাকা। এই ব্যয় নির্বাহ হতে হবে যোগ্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
পীত জ্বর বা ইয়ালো ফিভার শত শত বছর ধরে মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্ট দিয়েছিল, কিন্তু এই রোগের কারণ কিংবা রোগ প্রতিরোধের উপায় কারো জানা ছিলো না। রোগে ভুগে লাখ লাখ মানুষ রক্তক্ষরণ, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অকার্যকর হয়ে পড়া এবং এমনকি মৃত্যুবরণ করাসহ অনেক ধরনের শারীরিক সমস্যায় আক্রান্ত হচ্ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর সার্জন ওয়াল্টার রীড-এর নেতৃত্বে পরিচালিত এক গবেষণা থেকে জানা গিয়েছিল যে পীত জ্বরের কারণ ভাইরাস যা মশার মাধ্যমে ছড়ায়। নতুন এই জ্ঞান বিজ্ঞানীদের পীত জ্বরের কারণ ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করার সুযোগ করে দিয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রকফেলার ফাউন্ডেশনে কর্মরত দক্ষিণ আফ্রিকান বিজ্ঞানী ম্যাক্স থেইলার মুরগির ভ্রুণ ব্যবহার করে পীত জ্বরের টিকা আবিষ্কার করেছিলেন।
ওয়াল্টার রিড আর্মি ইনস্টিটিউট অফ রিসার্চ-এর সংক্রামক রোগ গবেষণা কেন্দ্রেরর পরিচালক ড.নেলসন মাইকেল পিইপিএফএআর চালু করতে সহায়তা করেছেন এবং তিনি ইবোলা ও জিকা রোগের জন্য ভ্যাকসিন তৈরিতে সহায়তা করেছেন। তিনি এখন এইচআইভি এবং কোভিড-১৯ ভাইরাসের বিরুদ্ধে টিকা তৈরির গবেষণা করছেন।
রাশিয়ার যে গ্যামেলিয়া ইনস্টিটিউট সার্স কভিড ২ টিকা আবিষ্কার করেছিল তারাই আবার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ও ভেক্টর ইনস্টিটিউটের সহায়তায় কোভিড ১৯ টিকা স্পুটনিক ভি আবিষ্কার করেছে।
দেশ ও জাতি এখন অস্তিত্বর সঙ্কটে, অন্যরকম এক যুদ্ধের মুখোমুখি। এমনি এক ক্রান্তিকালে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বিজয়কে সুসংহত করার সুযোগ কেবল সেনা সদস্য বলে কথা নয়, দেশ ও জাতির সকল সদস্যকেই আপ্লুত করবে।
লেখক : প্রকৌশলী


















































