শেক্সপিয়ারের সাহিত্যে জীবনের গভীরতা

রতন কুমার তুরী »

বিশ্বখ্যাত ইংরেজ সাহিত্যিক উইলিয়াম শেক্স​পিয়ার জন্ম গ্রহণ করেন ২৬ এপ্রিল ১৫৬৪ আর মৃত্যুবরণ করেন একই মাসে ১৬১৬ খ্রীস্টাব্দে।
এই সাহিত্যিকের জীবন তাঁর সাহিত্যের মতোই বৈচিত্র্যপূর্ণ। আজও নানা রহস্যে ঘেরা তাঁর জীবনের অনেক অধ্যায়। মধ্যযুগ থেকে গবেষণা করেও শেক্সপিয়ারের জীবনের রহস্য উন্মোচন করা আজও সম্ভব হয়নি। একজন শেক্সপিয়ারের পক্ষে কীভাবে সম্ভব হলো তাঁর নাটকগুলোতে অতীমানবিয় কিছু সংলাপ এবং দৃশ্যের সংযোজন করা এ প্রশ্ন যুগেযুগে সব বোদ্ধা সাহিত্যসেবিদের। শেক্সপিয়ার লিখেছেন অনেক কম কিš‘ যা লিখেছেন তা মানব সভ্যতা তথা মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছেন প্রবলভাবে। পাঁচ দশকেরও কিছু বেশি পৃথিবীর আলোবাতাস আস্বাদন করা জীবনে শেক্সপিয়ার ট্র্যাজেডি, কমেডি, ইতিহাসনির্ভর প্রায় ৪০টি নাটক, পৌনে ৪০০ কবিতায় সমৃদ্ধ–সফল সাহিত্যকর্মের জনক। এর সবটাই তাঁর নিজের রচনা একথা একেবারে সঠিক। অথচ এসব রচনা নিয়েও আছে ব্যাপক মতপ্রার্থক্য। শেক্সপিয়রের রচনাগুলো আসলেই তাঁর রচনা কিনা এমন প্রশ্নেরও অবতারণা করেছেন কেউ কেউ।
মানবচরিত্রের এমন বিস্ময়কর পরিধির যিনি উন্মোচন করেছেন, তিনি কেনো নিজের স্ত্রীকে মৃত্যুর আগে উইলে শুধু একটি বিছানাই দিয়ে গিয়েছিলেন। এ কি নিছক ঠাট্টা অথবা রাগ ? সুরাহা নেই। সেসব প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে তাঁর সম্পর্কে কিছু তথ্য জানিয়ে রাখি: শেক্স​পিয়ারকে ব্যাপটাইজ করা হয় ১৫৬৪ সালের ২৬ এপ্রিল। খ্রিস্ট ধর্মমতে সাধারণত শিশু জন্মের তিন দিন পর এটা করা হতো বলে ধারণা করা হয়। তাঁর জন্ম হয় ২৩ এপ্রিল ১৫৬৪। ১৫৮৫ সাল পর্যন্ত জন্মস্থান স্ট্রাটফোর্ড-অন-অ্যাভন-এ শেক্স​পিয়ারের শিক্ষাজীবন, বিয়েসহ অন্যান্য বিষয়ে জানা গেলেও তাঁর জীবনের সাতটি বছর (১৫৮৫-৯২) সম্পর্কে কিছুই জানা যায় না। তাঁর জীবনের এই সময়কালকে গবেষকেরা ‘লস্ট ইয়ারস’ বা ‘হারানো বছরসমূহ’ বলে অভিহিত করেন। কোনো কোনো জীবনীকারের ভাষ্যে, ওই সময় তিনি ফেরারি ছিলেন। আর তাঁর অপরাধটি কী ছিল? প্রতিবেশীর সীমানায় হরিণ শিকার। বলাবাহুল্য, সে সময় একে অনেক বড় অপরাধ গণ্য করা হতো। কারও কারও মতে, এই সময় শেক্​সপিয়ার এক কসাইয়ের সহকারী কিংবা একজন শিক্ষক অথবা পাদ্রি কিংবা এক আইনজীবীর কেরানি পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কারণে ১৫৯৩ সালের জানুয়ারিতে বন্ধ ঘোষণা করা হয় লন্ডনের অনেক থিয়েটার ও জনসমাগমের কেন্দ্র। শেক্সপিয়ার ততদিনে একজন অভিনেতা ও নাট্যকার হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেছেন। এই সময়ে তিনি রচনা করেন দুটি দীর্ঘ কবিতা এবং তা উৎসর্গ করেন সাউদাম্পটনের তৃতীয় আর্ল হেনরি রিওথেসলিকে। ধারণা করা হয়, এই আর্লই শেক্সপিয়ারের সনেটগুলোতে বারবার উদ্দিষ্ট সুদর্শন অনামা যুবক।
মাত্র এক বছরে (১৫৯৯) মাচ অ্যাডো অ্যাবাউট নাথিং, অ্যাজ ইউ লাইক ইট, জুলিয়াস সিজার, দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর—নাটকগুলো লেখেন শেক্স​পিয়ার। ১৬০১ সালে তিনি রচনা করেন তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত নাটক হ্যামলেট। ‘টু বি অর নট টু বি’ এই নাটকেরই উক্তি। অনেকেরই ধারণা, এটি শেক্স​পিয়ারপুত্র হ্যামনেটের শোকের ছায়া। ১৫৯৬ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে হ্যামনেট অজানা রোগে মৃত্যুবরণ করেছিল। আবার হ্যামলেট রচনার বছরেই তাঁর বাবাও মৃত্যুবরণ করেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, ‘সাহিত্যের প্রথম আধুনিক মানুষ’ হ্যামলেট-এর মধ্য দিয়ে পিতার মৃত্যুতে শোকাতুর পুত্রের বিষণ্নতা প্রকাশ পেয়েছে।
মার্চেন্ট অব ভেনিস এর সওদাগর চরিত্র অথবা আদালতের সেই যুক্তিতর্কের খেলা, ওদিকে হেনরি এইট আর দ্য মেরি ওয়াইভস অব উইন্ডসর নাটক দুটির সেই চিকিৎসক চরিত্রগুলোকে মনে আছে? সম্প্রতি ধারণা করা হচ্ছে, লন্ডনে শেক্সপিয়ারের প্রতিবেশীরা তাঁর সৃষ্ট এই রকম বৈচিত্র্যময় চরিত্রগুলোর উৎস। চিকিৎসক, সংগীতশিল্পী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার এই প্রতিবেশীরা একসময় ইউরোপের বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রগুলোতে যাতায়াত করতেন। চিন্তায় তাঁরা ছিলেন আধুনিক। প্রতি সপ্তাহেই গির্জায় তাঁদের সঙ্গে দেখা হতো শেক্স​পিয়ারের। তাই এই ধারণাকে উড়িয়ে দেওয়ার জো নেই। অন্যদিকে, এই নাট্যকারের অনেক জীবনীকারই বিভিন্ন সময়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন, আদৌ শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো তাঁর রচিত কি না। তাহলে সেগুলো কারা রচনা করেছেন? এই অনুমানের তালিকায় প্রায় অর্ধশত লেখকের মধ্যে এসেছে স্যার ফ্রান্সিস বেকন, ক্রিস্টোফার মার্লো; এমনকি রানি এলিজাবেথেরও নাম।
তথ্য সংগ্রহের সুযোগ যে যুগে সীমিত, সেই সময় শেক্স​স্পিয়ার যেমন দ্রুত বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করতেন, তেমনি নতুন নতুন শব্দ ও প্রবাদপ্রতিম বাক্য তৈরি করতেন। তিনি ৩০০-এর বেশি নতুন শব্দ তৈরি করেছেন; অ্যামেজমেন্ট, ইউজফুলসহ যার অনেকই আজও ব্যবহৃত হয়। একজন সাধারণ মানুষ গড়ে ২ হাজার শব্দ ব্যবহার করেন, শেক্স​পিয়ারের লেখায় এই সংখ্যা ২৫ হাজারের বেশি। তাঁর ব্যবহৃত ‘শেষ ভালো যার, সব ভালো তার’, ‘যা হয়ে গেছে তা তো হয়েই গেছে’, ‘বেশি ভালো ভালো নয়’ এমন বাক্যগুলো আজও বহুল ব্যবহৃত।
১৬১৬ এর ২৩ এপ্রিল মৃত্যুর পরের ৪০০ বছরে অন্য যেকোনো লেখকের চেয়ে শেক্স​পিয়ারের রচনা সবচেয়ে বেশি পঠিত, অভিনীত, অনূদিত ও চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। বাংলাসহ কমপক্ষে ৮০টি ভাষায় অনুবাদ হয়েছে তাঁর লেখা। বাংলায় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শেক্সপিয়ার রচিত কমেডি অব এররস-এর অনুবাদ করেন ভ্রান্তিবিলাস (১৮৬৯) নামে। এর অনেক পরে মুনীর চৌধুরী টেমিং অব দ্য শ্রু নাটকের বাংলা অনুবাদ করেন মুখরা রমণী বশীকরণ নামে। প্রকৃতপক্ষে শেক্সপিয়ার তাঁর নাটক সমূহে তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের ইংরেজ সমাজের দ্বান্দ্বিক বিষয়গুলো যেমন তুলে ধরেছেন তেমনি মানব সমাজে মানুষে মানুষে যে সম্পর্ক তার গভীরতা ও তুলে ধরেছেন। তৎকালীন সময়ে ইংল্যান্ডের সমাজ বাস্তবতায় শেক্সপিয়রের লেখাগুলো যেমন গ্রহণযোগ্য ছিলো তেমনি তাঁর লেখনি সমূহ সমানভাবে এখনও গ্রহণযোগ্য।
তাই এখনও হেমলেট, টু বি অর নট টু বি, মিড সামার নাইটস ড্রিম, ফেয়ারি কুইন এর মতো শেক্সপিয়ারের নাটকগুলো দর্শক এবং পাঠকদের বিমোহিত করে।