এএম মহিউদ্দিন »
এ কথা আর বলার বা বর্ণনার অপেক্ষা রাখে না যে, ঘাতক ব্যাধি ক্যান্সার এখনো মানব সভ্যতার এক বড় চ্যালেঞ্জ। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অনেক দূর এগিয়েছে সত্য কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে এখনও অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। আর এ জন্যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সচেতনতা। কেবল নিরাময় আয়োজনে নয়, বিজ্ঞানের সুফল ঘরে তুলতেও সচেতনতার বিকল্প নেই। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অর্থনৈতিক ও শিক্ষা-দীক্ষায় অনগ্রসর ও পশ্চাদপদ সমাজ ব্যবস্থায় ক্ষেত্র বিশেষে ব্যাধি নিরাময়ের চাইতে সচেতনতার সংকট প্রকট। অনুরূপ কারণে আমাদের দেশ বাংলাদেশ আজও শিশুতোষ ক্যান্সার রোগ মোকাবেলায় প্রায় অক্ষম ও সংকটপীড়িত দেশ।
দেশের একটি বড় অংশ এখনও চরম দারিদ্র্যপীড়িত। শহরাঞ্চলের শতকরা প্রায় ২১ ভাগ এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৩৫ ভাগ দারিদ্র্য সীমার নীচে রয়েছে। উল্লেখ্য, সমগ্র জনগোষ্ঠীর শতকরা প্রায় ৬৩ ভাগ গ্রামে বসবাস করে। তদরূপ শিক্ষার হারও বিশ্বমানের নিম্ন সূচিতে রয়েছে। অক্ষরজ্ঞানহীন এখনো শতকরা প্রায় ২৫ ভাগের বেশি।
উপরন্তু মাত্র ১ লক্ষ ৪৭ হাজার বর্গকিলোমিটারে ছোট্ট এই দেশে সেই জনসংখ্যা প্রায় ১৬০ মিলিয়ন। প্রতি কিলোমিটার প্রায় ১২ শত জন লোকের (উবহংরঃু ড়ভ চড়ঢ়ঁষধঃরড়হ) বসবাস। যা বসবাস ঘনত্বে বিশ্বের সর্বোচ্চ। কারণেই অশিক্ষা, দারিদ্র্য ও অত্যধিক জনসংখ্যার ত্রিমুখী চাপে নাজুক আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা। প্রতি ১০ হাজার জন জনসংখ্যার জন্য গড়ে ৫.২৫ জন জেনারেল প্র্যাকটিশনার পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ক্ষেত্রে এই হার অনুল্লেখ্য। ফলত এখনো আমাদের দেশের শতকরা ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ নানান ধরনের উদ্ভট, হাতুড়ে, কাল্পনিক এবং পুরানো ধ্যান-ধারণার চিকিৎসার শরণাপন্ন হতে বাধ্য হয়। প্রচলিত এসব পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে স্বপ্নে পাওয়া ঔষধ, ঝাড়-ফুঁক (ধর্মীয় আবেগ নির্ভর) ইউনানী, আয়ুর্বেদিক, কবিরাজি, পাহাড়ি মঘি ইত্যাদি।
সামগ্রিক এই হতাশাব্যঞ্জক চিত্রের মধ্যেও আশার কথা হচ্ছে, গত দেড় দশকে বিশ্বময় শিশুদের ক্যান্সার চিকিৎসার অগ্রগতির কিছু প্রভাব আমাদের দেশে পৌঁছেছে- তবে তা নিতান্তই ছিটে-ফোঁটা- কাক্সিক্ষত মাত্রার অনেক নীচে। দেশের ৬৮টি জেলার মধ্যে কেবল রাজধানী ঢাকা ও একমাত্র সমুদ্র বন্দর নগর চট্টগ্রাম ছাড়া কোথাও শিশুতোষ ক্যান্সার নিরূপণ বা নিরসনের ন্যূনতম ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এমনকি প্রধান শহর ২টিতে প্রাথমিক রোগ নির্ণয়ের (ঊধৎষু উরধমহড়ংরং) যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে তাও পূর্ণভাবে কাজে লাগানো এখনো সম্ভব হয়নি। সচেতনতা সংকটই এর প্রধান কারণ। দুঃখজনকভাবে এ ক্ষেত্রে সরকারি কোন উদ্যোগ বা ভূমিকা নেই বললে চলে।
কেবল হাতে গোনা গুটি কতক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সীমিত সাধ্যে কিছু প্রচারণা কার্যক্রমে প্রাণান্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষণে সর্বাগ্রে প্রয়োজন, দেশে বিদ্যমান শিশু ক্যান্সার রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের সুযোগ গ্রহণের জন্য সর্বসাধারণকে উদ্বুদ্ধকরণ তথা গণসচেতনতা সৃষ্টি করা। মান্ধাতার মানসিকতা ও পশ্চাদপদ ধ্যান ধারণা থেকে মুক্ত করে সময়মত আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় সঠিক ভাবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা আয়োজন। এ লক্ষে আমাদের সংগঠন ক্লাশ ও তাদের কর্মতৎপরতা সংগঠিত ও পরিচালিত করছে। ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয়ের জন্য আমাদের নানামুখী কর্মপরিচালনা ও কর্মকা-ের মধ্যে রয়েছে। গণ সচেতনতামূলক পোস্টার, লিফ্লেট, পুস্তিকা প্রকাশ ও বিতরণ।
বিভিন্ন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে ঙৎরবহঃধঃরড়হ গববঃরহম আয়োজন এবং ক্যান্সার পেরেন্টসদের সাথে কাউন্সিলিং ইত্যাদি।
সকল ছাত্রদের সাথে ঙৎরবহঃধঃরড়হ চৎড়মৎধসসব এ আমরা সাধারণত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং অভিজ্ঞ পেরেন্টসদের সম্পৃক্ত করে থাকি। দৃশ্যত আমাদের এই সচেতনতামূলক কার্যক্রমে বাস্তব সাড়া লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। ১৯৯৯ সালে আমাদের কার্যক্রমের যাত্রা প্রাক্কালে চট্টগ্রামের একমাত্র সরকারি হাসপাতালে যেখানে চিকিৎসা প্রার্থীর (ক্যান্সার শিশু) সংখ্যা ছিল মাসে ১১ জন তদস্থলে বর্তমানে সেই সংখ্যা ৭০ এর বেশি। তেমনি রাজধানী ঢাকায়, বিভিন্ন হাসপাতালে এই সংখ্যা বর্তমানে মাসে গড়ে ১১০ জনের মতো।
আশার কথা হচ্ছে গত কয়েক বৎসরে প্রধান সরকারি ২/৪টি হাসপাতালের পাশাপাশি ঢাকা ও চট্টগ্রামের অর্ধশতাধিক প্রাইভেট ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে অনকোলজিক ও হেমোটোলজিস্ট চিকিৎসকরা শিশুতোষ ক্যান্সার রোগ নির্ণয় করছে। ফলে কয়েক বৎসর পূর্বের চাইতে এখন রোগীদের প্রাথমিক রোগ নির্ণয় সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধারা অব্যাহত রাখতে আরো ব্যাপক উদ্যোগ আয়োজন ও প্রচারণার প্রয়োজন।
লেখক : চিলড্রেন লিউকেমিয়া এসিসটেন্স এন্ড সাপোর্ট সার্ভিসেস (ক্লাশ)