ড. মুহাম্মদ ইদ্রিস আলী »
বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ তম বার্ষিকীতে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। মাঝখানের ২১ বছর বাদ দিলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাগুলো এক এক করে অর্জিত হচ্ছে সন্দেহাতীতভাবে। দেশ লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কভিডের বিশ্বমারি দেশকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। সতের কোটি মানুষের দেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা, চেতনা আমাদের অদম্য অগ্রযাত্রার আলোকবর্তিকা । বিভিন্ন বৈপরীত্যের পরেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের অগ্রযাত্রা বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশকে কাক্সিক্ষত লক্ষে নিয়ে যাওয়ার কাজটি সম্পাদন করে চলেছে। অদম্য বাংলাদেশের জন্য যা অত্যন্ত প্রত্যাশিত।
নতুন সরকারের মন্ত্রি পরিষদ যাত্রা শুরু করেছে প্রায় এক বছরের বেশি হলো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, প্রত্যয়, অধরা স্বপ্নলোকে জয় করার জন্য নতুন সরকারের যাত্রা। ইতিমধ্যেই আমরা শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, কৃষিতে এবং অন্যান্য উন্নয়ন অনুষঙ্গে আমাদের শুভযাত্রাকে যথার্থ ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দিয়ে, বঙ্গবন্ধুর রক্তের ¯্রােতধারার যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে, সততা, নিষ্ঠা এবং স্বপ্নজয়ের বাসনা দিয়ে।
এতদসত্ত্বেও নিবিড়ভাবে তাকালে অসঙ্গতি, অনিয়ম, নির্লিপ্ততা চোখ এড়িয়ে যায় না। শিক্ষা প্রশাসনের কথা ভাবা যাক। শিক্ষা প্রশাসনের শীর্ষস্থানে তারুণ্যের প্রয়োগ, বিনিয়োগ ঘটেছে। জাতিকে আশা দেখানোর, আশাজাগানিয়া বিনিয়োগ।
কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য যে, অগ্রগতি যেভাবে সাধিত হওয়া দরকার- তা হয়নি। এদিক ওদিক তাকানো শিক্ষা প্রশাসন কাক্সিক্ষত মাত্রায় সুশাসন কিংবা প্রচলিত শাসনের কাছাকাছিও পৌঁছাতে পারছে না। অথবা চেষ্টা করছে না।
এ সেক্টরে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বপ্নভঙ্গ হচ্ছে। অচেনা, অহেতুক, অকারণে শিক্ষা প্রশাসনে কর্মকা-গুলো একই বৃত্তে বারবার আবর্তিত হচ্ছে। পদোন্নতি কিংবা প্রশাসনিক পদগুলোর কথাই যদি ভাবা যায়, তাহলে আমরা কী দেখি? সারাদেশে বা অঞ্চল বিশেষে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদÑপদবীগুলো দিনের-পর-দিন শূন্য থেকে যাচ্ছে। কাগজে-কলমের তত্ব হয়ে থাকছে। পদায়ন হচ্ছেনা। তাড়নায় যাচ্ছে না। ভারপ্রাপ্তরা কাজ করছে, ভারাক্রান্ত হচ্ছে। তাদের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়া হচ্ছে কোন রকম করে।
এদের অনেকের যোগ্যতার মূল্যায়ন বা পরিমাপ হয়নি। এখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা সিদ্ধান্তহীনতার নির্লিপ্ততা, অমনোযোগিতা, অদূরদর্শিতা, দৃঢ়ভাবে বদ্ধমূল হয়ে সংকটকে সংক্রমিত করছে, বিস্তৃত করছে। এটি কোনোভাবেই আকাঙ্ক্ষা করা যায় না। নিকট অতীতে প্রশাসনিক পদ-পদবীতে বয়োজ্যেষ্ঠ, বয়োকনিষ্ঠের বিভ্রান্তি দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বিস্তৃত করা হয়েছে। এসব নিয়ে ক্ষোভ, বিক্ষোভ থাকলেও মনোপীড়া নিয়ে অনেকেই চাকরি করে যাচ্ছেন। এরকম আবহে, পরিবেশে সুশাসন কিংবা দক্ষতা আশা করা যায়না।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একজন মরহুম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নাম কখনোই মুছে ফেলা যাবেনা।ইতিহাসের সাথে মিশে যাওয়া এই মহান ব্যক্তির ত্যাগ-তিতিক্ষা, জনগণের সাথে সম্পৃক্ততা, জনসেবা, জনমানুষের আবহে নিজেকে তিল তিল করে পোক্ত করার কথা মানুষ কোনদিনও ভুলবে না। এভাবে একজন মহিউদ্দিন চৌধুরী সৃষ্টি হওয়া ছিল দীর্ঘদিনের সংগ্রামের পথে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার ফসল। সরকার শিক্ষা প্রশাসনের দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে তাঁর যোগ্য সন্তানকে প্রশাসনিক দায়িত্ব দিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরীকে সম্মানিত করেছে। চট্টগ্রামের মানুষদের সম্মানিত করেছে। এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পথে তারুণ্যকে গুরুত্ব দিয়েছে। যথার্থ বিনিয়োগ করেছে। একইভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয়ও আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের পরীক্ষিত ঘর থেকে নিজেকে পরীক্ষা নিরীক্ষায় উত্তীর্ণ করে সরকারের সাথে যুক্ত আছেন। উল্লেখযোগ্য এই মানুষগুলোর প্রতি এদেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা অনেক বেশি, অনেক বিস্তৃত।
চট্টগ্রামের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার আঞ্চলিক পরিচালকের পদ দীর্ঘদিন যাবৎ খালি আছে। এভাবে খোঁজ নিলে দেখা যায়, একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক পদ, অধ্যক্ষ-উপাধ্যক্ষের পদ খালি খালি যাচ্ছে, খালি পড়ে আছে, খালি রাখা হচ্ছে। একজন কৃষক যদি তার সব জমিতে চাষ না দিয়ে খালি ফেলে রাখে, তাকে যোগ্য কৃষক, যথার্থ কৃষক বলা যায় না। আমরা স্বপ্নজয়ের আগেই আমাদের যথার্থতা হারিয়ে ফেলছি কেন? নির্লিপ্ততায়, অবহেলায়, অমনোযোগিতা এবং অন্য কোন প্রক্রিয়ায় আমাদের গা ভাসিয়ে আমরা কোন স্বপ্নকে জয় করতে চাই?
দেরিতে হলেও অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে গত আগস্ট মাসে অধ্যাপকদের পদোন্নতি সম্পাদিত হয়েছে। আরো অনেকগুলো টায়ার আছে। প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক। চাতক পাখির মতো তাকিয়ে আছে ভুক্তভোগীরা। জট খুলেতো খুলে না, বরফ গলেতো গলে না। দীর্ঘদিনের পদোন্নতির আকাক্সক্ষা নিয়ে বিভিন্ন পদের চাকরিজীবীরা পদের বর্ণিত ফিডার সময় পার করে অপেক্ষমান আছে। তারা কেউ পাকিস্তানি নয়। এ দেশেরই মানুষ। এদেশের নাগরিক। তাদের পদোন্নতি নিয়ে দিন-ক্ষণ তারিখ ঠিক হচ্ছে না। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। রাজনৈতিক অবহেলা। প্রশাসনিক নির্লিপ্ততা এবং প্রত্যয়-এর ঘোর না কাটা।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে সুশাসন এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে হাঁটছেন, মনে হয় না তার বহর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রণালয় সেই ভাবনাকে ধারণ করে। সেই ভাবনার পথে চলে। এটা কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত নয়।
প্রশাসনিক পদগুলো পূরণ করে কাক্সিক্ষত সময়ে পদন্নতির ব্যবস্থা করে সুশাসন, স্বচ্ছ শাসন মে উপহার দেয়া যায়, জনমানুষের আস্থায় যে স্থান করে নেয়া যায়, সে প্রক্রিয়ার সুষ্ঠু প্রতিফলন বাংলাদেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আপাতত সুদূরপরাহত মনে হচ্ছে।
ফিরে আসি শিক্ষা প্রশাসনের খালি পদগুলোর বিষয় নিয়ে। বাংলাদেশের প্রত্যয়ী অগ্রযাত্রায় একাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভারপ্রাপ্ত দিয়ে চলার মাহাত্ম্য আমরা বুঝিনা। একই পদের জন্য একাধিক ব্যক্তি, বহুপ্রকার মানুষ থাকা সত্ত্বেও সারাদেশব্যাপী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোর জন্য যোগ্য প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে খুঁজে পাচ্ছেনা আমলাতন্ত্র অথবা রাজনীতির পরিচালক পথিকরা।
দেশে যোগ্য পদে যোগ্য ব্যক্তির ঘাটতি হয়েছে কিংবা প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সম্পাদন করে তাদের পদায়ন করতে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে অথবা মনের মতো লোক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঘাটতি হয়েছে অথবা ব্যক্তিবিশেষের পছন্দের মানুষকে খুঁজে পেতে দেরি হচ্ছে অথবা ব্যক্তিবিশেষের পছন্দের মানুষ এখনও পরিপক্ক, পরিপূর্ণ হয় নাই- এই সবগুলো কথা এদশের বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য নয়।
শোনা যায়, মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ দুই ব্যক্তির ভিতর অঞ্চল ভাগাভাগি হয়েছে। একজন চট্টগ্রাম দেখবেন। অন্যজন দেশের বাকি অংশ দেখবেন। এই দেখাটা কবে শুরু হবে, কীভাবে হবে, কোন প্রক্রিয়ায় হবে, কখন হবে- তা কিন্তু জনগণ একসময় জানতে চাইবে।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের একাধিক অধ্যক্ষ- উপাধ্যক্ষের পদ খালি। খুব কম সময়ে আরো বেশকিছু পদ খালি হতে যাচ্ছে। আমাদের মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন জনগণ জানে না। আমরা জানি না। অনেক ক্ষেত্রে জানার প্রয়োজন আছে বলে আমরা মনে করি না। একজন অধ্যক্ষ চলে গেলে ৫০ জন ওই একই পদের জন্য প্রার্থী হয়। এখান থেকে একজনকে বাছাই করে নেয়ার কোন প্রক্রিয়া, কোন পথ, কোন পদ্ধতি যদি মন্ত্রণালয়ের কিংবা ব্যক্তি বিশেষের না থাকে- সেটা তাদের অযোগ্যতা। তাদের দুর্বলতা। তাদের নির্লিপ্ততা। জাতির উপর দায় চাপিয়ে দেয়া উচিত না।
আমরা বিশ্বাস করি, আমরা আশাকরি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ শিক্ষার বিকাশে, প্রশাসনিক স্বার্থে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে যথাযথ পদক্ষেপগুলো যথাসময়ে, যথাযথভাবে গ্রহণ করবে, সম্পাদন করবে এবং জনগণকে আস্থাবান করবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে তারা নিবিড়, নিসংকোচে, নিবিষ্টভাবে কাজ করে যাবে। একাত্তরের বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির স্বপ্ন পূরণের বাংলাদেশের কাছে পৌঁছে দেবে। মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধার অতৃপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হবে। লাখো শহীদের রক্তের ঋণকে চেতনা চর্চায় উদ্ভাসিত করবে- মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এটাই একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, অধ্যাপক,
কর্ণফুলী গবেষক