মোহাম্মদ অংকন »
শিক্ষার সাথে ‘পরীক্ষা’ শব্দটা প্রবলভাবে জড়িত। কৌতুক করে বলা হয়, ‘আমি হতাম সবচেয়ে সেরা ছাত্র, যদি পরীক্ষা না থাকত।’ শিক্ষাকালীন শিক্ষার্থীরা কী শিখল, তারই মাপকাঠি ‘পরীক্ষাব্যবস্থা’। শিক্ষাগ্রহণের একধাপ থেকে আরেকধাপ উতরাতে পরীক্ষার বিকল্প নেই। উতরাতে না পারাই ফেল (অকৃতকার্য)। তবে প্রশ্ন,শুধু পরীক্ষায় পাস-ই কি ছাত্রত্ব, শিক্ষিত কিংবা চাকরিযোগ্য ব্যক্তি নির্ধারণের মানদ-?
ফেসবুকের মাধ্যমে নিচের লেখাটি পেয়েছি। আসুন, পড়ি। রাশিয়ায় অধ্যয়নরত এক ছাত্র লিখেছে, ‘রাশিয়ায় পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়া হয় পাঁচ আর কেউ কোনো উত্তর না লিখে সাদা খাতা জমা দিলেও তাকে দেওয়া হয় দুই।মস্কো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম দিনটিতে আমি পরীক্ষার এই নম্বর পদ্ধতি সম্পর্কে জানতাম না। জেনে অবাক হয়ে ড. থিওদর মেদ্রায়েভকে জিজ্ঞেস করি,‘‘একজন ছাত্র কিছুই না লিখে দুই নম্বর পাবে, এটা কী যৌক্তিক! তার তো শূন্য পাওয়াটাই সঠিক।’’
ড.মেদ্রায়েভ উত্তর দেন, ‘‘একজন মানুষ এতো শীতের মধ্যে সকাল সাতটার ক্লাসগুলো ধরতে আরো আগে ঘুম থেকে উঠেছে, গণপরিবহনে চড়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ক্লাসরুমে পৌঁছেছে; প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চেষ্টা করেছে, তাকে কী করে শূন্য দিই! যে তার রাতগুলোতে পড়ালেখা করেছে, কলম-নোটবুক-কম্পিউটার কিনেছে পড়ালেখার জন্য; জীবন-ধারায় এতো ত্যাগ সাধন করেছে পড়ালেখার জন্য, তাকে কী করে শূন্য দিই!একজন ছাত্র উত্তর লিখতে পারেনি জন্যই তাকে আমরা শূন্য দিতে পারিনা, বাবা।
আমরা মানুষ হিসেবে তাকে শ্রদ্ধা জানাতে চাই; তার মেধা আছে, সে কমপক্ষে চেষ্টা করেছে। যে ফলাফল আমরা দিই, এটা শুধু উত্তরপত্রে লেখা উত্তরের ওপর ভিত্তি করে হতে পারে না। এই ফলাফল দেওয়া হয় তার প্রশংসা করতে আর সে যেহেতু মানুষ,সে ন্যূনতম একটা নম্বর পাবার যোগ্য।’’
ফেসবুকের এই স্ট্যাটাসটি আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষকদের মন-মানসিকতা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালার মানদ-ে নিছক ‘স্ট্যাটাস’ই কিংবা ভিত্তিহীন কোনো গল্প, যার কোনো মূল্য নেই। একজন ছাত্র পরীক্ষার খাতায় কিছুই লিখবে না, তাকে নম্বর দেওয়া হবে এ যেন গুরুতর অপরাধ এই দেশের পরিপ্রেক্ষিতে। শিক্ষকদের চাকরি-ই থাকবে না। ক্ষেত্রবিশেষ ফেল করানো হলে আমাদের দেশের শিক্ষকরা প্রশংসাও পেয়ে থাকেন।
অভিযোগ আছে, দেশের বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ফেল করিয়ে দেওয়া, তুলনামূলক কম নম্বর দিয়ে পাস করানো (যাতে পরবর্তীতে বাধ্য হয়ে সেসব বিষয় ‘ইমপ্রুভ’ নিতে হয়) একধরনের ব্যবসায়িক মানসিকতার প্রতিফলন বলেই প্রচলিত। শিক্ষার্থীকে ফেল করাতে পারলেই সে বিষয় পরের সেমিস্টারে পুনরায় নিতে হবে, নির্দিষ্ট ফি দিতে হবে। ফি দেওয়ার এই সংখ্যা যতই বাড়বে, তত ‘শিক্ষাব্যবসা’র প্রসার ঘটবে। প্রশ্ন হতে পারে, আসলেই কি এই ধরনের কাজ কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করে? সত্যই করে বৈ কী, কোনো শিক্ষার্থী সামান্য কিছু নম্বরের জন্য ফেল করে? বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ের একজন শিক্ষার্থী যখন ফেলের মুখোমুখি হয়, তখন এরচেয়ে দুঃখজনক কী-বা হতে পারে। ড. মেদ্রায়েভ’র কথা ধরে বলতেই হয়- একজন শিক্ষার্থীকে কি শুধু পরীক্ষার খাতার লেখার মাধ্যমে মূল্যায়ন করতে হবে? সে কী সারা বছর কিছুই করে না?
আমি তো মনে করি, প্রতিটি শিক্ষার্থীই তার মনে স্বপ্ন বোনে। পাস করে বের হয়ে সে পরিবারের দায়ভার কাঁধে তুলে নিবে, জীবিকানির্বাহ করবে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।
অথচ ‘ফেল’ সেই স্বপ্নকে সাইক্লোনের মত ধ্বংস করে দেয়। পরীক্ষায় শূন্য নম্বর দেওয়া কিংবা ফেল করানোর ফলে ছাত্রদের মানসিকতাকে সংকীর্ণ করে দেওয়া হয়, এছাড়া কিছুই নয়। তাদেরকে শেষ করে দেওয়া হয়, তারা আর লেখাপড়াকে পছন্দ করতে পারে না। আত্মহত্যার দিকে ঝোঁকে। প্রায়ই খবর আসে, ওমুক বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। খোঁজ নিলে দেখা যায়, পড়াশোনা আর পরীক্ষার চাপ সহ্য করতে না পেরে এ পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছে।
আমাদের দেশের শিক্ষকরা নীতিকথা বললেও তাদের অনেকের মধ্যে নৈতিকতার প্রবল ঘাটতি। তারা চিন্তা করেন, ‘আমি যেভাবে এতদূর এসেছি, হে শিক্ষার্থীগণ তোমাদেরকেও সেভাবেই আসতে হবে। আসতে গিয়ে উষ্ঠাখেয়ে পড়ে গেলেও আমরা দায়ী না।’ আসলেই তারা দায়ী নন। আসলে শিক্ষা নিয়ে অসম প্রতিযোগিতা এবং শিক্ষা অর্জনকে চাকরিপ্রাপ্তির মূল লক্ষ্য ভাবার কারণে বর্তমান সিস্টেমের বিকল্প কিছুই ভাবা হয় না। কর্মদক্ষতার চেয়ে, প্রতিভার চেয়ে সার্টিফিকেটের গ্রেডিং পয়েন্টকে মূল্যায়ন করা হয় বেশি। যার গ্রেডিং বেশি তাকে, প্রশিক্ষণ দিয়ে হলেও কাজে লাগাতে কর্তৃপক্ষ রাজি; কিন্তু একজন প্রতিভাবান কিংবা কর্মঠ বিপরীতে গ্রেডিং কম থাকায় তাকে মূল্যায়ন করার কোনো সুযোগ নেই। ওর রেজাল্ট ভালো না তো ও কিছুতেই ভালো না। তাই শিক্ষকগণ চান, সকল শিক্ষার্থী রেজাল্ট ভালো করুক। কিন্তু তারা তো সবার ফলাফল ভালো করাতে পারেন না।
আমাদের দেশে জিপিএ ফাইভ প্রাপ্তির জন্য যে লড়াই হয়, অন্যান্য দেশে বেঁচে থাকার জন্যও এমন লড়াই করতে হয় না বলে মনে হয়। আসলেই হয় না। নচেৎ রাশিয়ার ঐ লেখাটি এমনই এমনই লেখা হত না। অবশ্যই এর প্রাসঙ্গিকতা আছে।
বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থাকে আরও জটিলতর করা হচ্ছে। বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে বইয়ের বোঝা। বিচার করা হচ্ছে না যে শিক্ষার্থীদের ধারণক্ষমতা কতটুকু? শুধু তাই নয়, ‘ভালো রেজাল্টের বিকল্প নেই’ বলেও কানপড়া দেওয়া হচ্ছে। ভালো রেজাল্ট করতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা যে ‘রোবট’ হচ্ছে, তার দিকে পরিবার কিংবা সরকার কেউই নজর দিচ্ছে না। একটা বিজ্ঞাপনে দেখলাম, এক শিক্ষার্থীর মা আরেক শিক্ষার্থীর মাকে বলছেন, ‘ভাবি, আমার ছেলেটা বছর বছর ফার্স্ট হয় আর এবার পরীক্ষাই হল না।’ জবাবে তিনি বলছেন, ‘আমি পরীক্ষা নিয়ে ভাবি না। আমার ছেলেটা কী শিখল, সেটাই আসল।’ করোনাকালে পরীক্ষা না হওয়ার মধ্যদিয়ে এটা প্রমাণ করে দিল যে, শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা না থাকলেও তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না, শুধু পড়েও শিক্ষিত হওয়া সম্ভব।
শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ‘ফেল’ শব্দটাকে বিলুপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এটা আমার দাবি। শুধু তাই নয়, গ্রেডিং সিস্টেমও বাদ দিতে হবে। পরীক্ষার মাধ্যমে মানদ- বজায় রেখে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসবে। তারা পাঠ্যপুস্তকের পড়া শিখবে। পাশাপাশি শিখবে নৈতিক শিক্ষা, জীবনগঠনের প্রয়োজনীয় সব কিছু।
শিক্ষাকে কীভাবে বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করা যায়, কীভাবে উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগানো যায়, কীভাবে প্রতিভাকে বিকশিত করা যায়, সেসব বিষয়ে সময় ও সুযোগ করে দিতে হবে। অসম পড়ার চাপ, সপ্তাহে সপ্তাহে পরীক্ষার চাপ, শিক্ষার্থীদেরকে বাহিরের জগৎ সম্পর্কে ভাবতে দেয় না। তারা ‘ঘরকুনো’ হয়ে পড়ে। বহির্বিশে^র স্কুল না টপকানো কেউ যখন বড় কিছু আবিষ্কার করে, বড় বড় পুরস্কার অর্জন করে, তখন আমরা শুধু অভিনন্দন জানাই না, সঙ্গে বলি, ‘ওরা খুব মেধাবী।’ মেধা কি আমাদের নাই? ধর্ম এবং বিজ্ঞান উভয় বলে, সকল মানুষের মেধা সম। সে আমেরিকান, তার দেহ বড়; আমি বাঙালি, আমার দেহ ছোট; কিন্তু মাথায় ব্রেনের পরিমাণ তো একই।
চীনে প্রতিটি শিশুকে স্বাবলম্বী হওয়ার শিক্ষা দেওয়া হয়। দশ-বারো বছরের বাচ্চাও নিজেদের তৈরি সাইকেল ব্যবহার করে চলাচল করে। তাই তো তারা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে এত এগিয়ে। একশো ত্রিশ কোটিরও বেশি জনসংখ্যা হলেও কেউ বোঝা নয়। জাপানে প্রাথমিক পর্যায়ে কোনো পরীক্ষাই নেওয়া হয় না। শিশুদের শেখানো হয় ধর্ম, নীতি-নৈতিকতা-আদর্শতা। আর বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণির নিচে আরও যে কত শ্রেণি আছে, তার হিসেব নেই। তিন বছরের বাচ্চার কাঁধেও ঝোলে বইয়ের ব্যাগ। ব্যাগের চাপে একটা জাতির মেরুদ- যে ক্রমশ বাঁকা হয়ে যাচ্ছে, তা আমাদের দেশের গুণীমহল ও নীতিনির্ধারকগণ দেখছেন না। তারা এটা ভাবছেন না যে তারা চলে গেলে তাদের মত যোগ্য কেউ আর আসার তেমন সুযোগ নেই। তাদের সমকক্ষ তৈরি করে যেতে হবে।
যে দেশে শিক্ষাখাতে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতি হয়ে থাকে, ভর্তি নিয়ে বাণিজ্য হয়, টাকা দিয়ে প্রশ্ন বেচাকেনা হয়, সে দেশে গুণীজন জনসম্পদ নয়, জন বোঝা হবে। আসলে উচ্চশিক্ষিত মানে গুণী নয়, এটা বুঝতে হবে। অথচ আজকাল পিএইচডি’র থিসিস চুরি করেও ডক্টরেট ডিগ্রীধারি হয় কেউ কেউ। বড় বড় পদ অর্জন করে। অন্যকে তারা নিজেদের মত করেই মূল্যায়ন করে। বিপরীতে প্রতিভাবানরা রাস্তায় পড়ে মরে। যে ছাত্র দেশপ্রেম নিয়ে রাজনীতি করে, তাকে জেলে যেতে হয়। আর যে দুর্নীতি করেও যেকোনো ক্ষমতাসীন সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা করে, সে কোনো কিছু না করেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়। বাংলাদেশই একমাত্র উদাহরণ যে ছাত্রদের ব্যাংকেও কোটি কোটি টাকা জমা থাকে।
শেষকথা, আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে। পরীক্ষা কিংবা ফেলের দুশ্চিন্তায় শিক্ষার্থীরা যেন সৃজনশীলতাকে বিনষ্ট না করে সে দিকে নজর দিতে হবে। গাছ লাগালেই হবে না, তার যতœ নিতে হবে। যারা জিপিএ ফাইভ, সিজিপিএ ফোর পাবে, তারা তো শুধু সার্টিফিকেটই পাবে। আর যারা লেখাপড়ার পাশাপাশি দেশউন্নয়ন, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল কাজ করবে, তাদের পরীক্ষার ফলাফল যাইহোক সার্টিফিকেট তো বটেই, মেডেল দিতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, বাংলাদেশ চিত্র, ঢাকা