লকডাউন : বাস-ট্রেনে ঘরমুখো মানুষের ভিড়
মোহাম্মদ কাইয়ুম <<
‘ভাই সিট খালি নাই, টিকেট নাই, অন্য কাউন্টারে দেখেন’ নতুন যাত্রী দেখেই ইউনিক পরিবহনের সেলসম্যান শহীদুল ইসলামের এমন সরল স্বীকারোক্তি। এরকম এক কাউন্টারে টিকেট না পেয়ে বাধ্য হয়ে অন্য কাউন্টারে ছুটছেন ঘরমুখো যাত্রীরা। আবার অনেকেই শেষ মুহূর্তে ট্রেনের টিকেট না পেয়ে ছুটছেন বাস কাউন্টারে। কেউবা বাস কাউন্টারে নির্দিষ্ট সময়ের টিকেট না পেয়ে ঢু মেরে দেখছেন ট্রেন স্টেশনে। এরকম টিকেট না পেয়ে এক কাউন্টার থেকে অন্য কাউন্টারে, বাস স্টেশন থেকে ট্রেন স্টেশনে বাড়িফেরা যাত্রীদের ছুটতে দেখা যায়। লকডাউনের আগের দিন গতকাল রোববার ঘরমুখো মানুষের বাড়িফেরার ছোটাছুটির দৃশ্য ছিল নগরীজুড়ে।
সরেজমিনে গতকাল রোববার বেলা ১১টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত নগরীর দামপাড়া বাস কাউন্টার, বিআরটিসি বাস কাউন্টার, শাহ আমানত সেতু সংলগ্ন বাস কাউন্টার এবং চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, লকডাউনে ঘরমুখো মানুষের উপচেপড়া ভিড়। সকাল ১১টার মধ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী বাস থেকে শুরু করেই বিভিন্ন রুটের বাসের বেশিরভাগ সিট বিক্রি শেষ হয়ে গেছে। অনেকেই গন্তব্যস্থলের টিকেট না পেয়ে এক কাউন্টার থেকে অন্য কাউন্টারে ছুটে চলছেন। আবার অনেকেই বিআরটিসি বাস কাউন্টারে টিকেট না পেয়ে ছুটে গেছেন দাম পাড়া বাস কাউন্টারে, কেউবা দাম পাড়া বাস কাউন্টার থেকে ছুটেছেন অলংকার মোড়ের বাস কাউন্টারে। এভাবে ঘরমুখো যাত্রীদের বাড়ি ফেরার নিয়ে উদ্বিগ্ন আর দুশ্চিন্তায় এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ছুটতে দেখা গেছে। আন্তঃজেলা যাত্রীদের পাশাপাশি চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাগামী যাত্রীদেরও বাড়ি ফিরতে বাস কাউন্টারে ভিড় করতে দেখা গেছে। অনেক জায়গায় যাত্রীদের তুলনায় বাসের সংখ্যা কম থাকায় ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্যও দেখা যায়।
সরেজমিনে সকাল ১১টায় দামপাড়া বাস কাউন্টারগুলো ঘুরে দেখা যায়, বেশিরভাগ বাস কাউন্টারে দিনের সব ধরনের টিকেট বিক্রি শেষ। কিছু কিছু বাস কাউন্টারে রাতের টিকেট থাকলেও যাত্রীদের তুলনায় খুবই সামান্য। অনেক কাউন্টারেও রাতের টিকেট বিক্রি শেষ। এসময় এনা ট্রান্সপোর্ট কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, দিনের সব টিকেটের পাশাপাশি রাতের সব বাসের টিকেট বিক্রি শেষ। অনেকে টিকেটের অন্য এসে ফিরে যেতে দেখা যায়। এ পর্যন্ত কেমন সিট খালি আছে? এমন প্রশ্নের জবাবে দামপাড়া এনা ট্রান্সপোর্ট কাউন্টারের ম্যানেজার মোহাম্মদ ইলিয়াস উদ্দিন বলেন, ‘লকডাউনে ঘরমুখো যাত্রীদের প্রচুর চাপ থাকায় সব টিকেট বিক্রি শেষ। সকাল থেকে ঢাকা,সিলেট ও টাঙ্গাইলসহ বিভিন্ন রুটে ১২টির মতো বাস ছেড়ে গেলেও একটিতে কোন আসন খালি ছিল না। এছাড়া সরকারের নির্দেশনা মতে প্রতি দুই সিটে একজন করে যাত্রী পরিবহন করাতে অন্য সময়ের চেয়ে যাত্রীদের চাপ একটু বেশি।’
দামপাড়া বাস কাউন্টারে কথা হয় মো. কামরুল হাসান নামে ঢাকাগামী এক যাত্রীর সাথে। এক কাউন্টারে বাসের টিকেট না পেয়ে অন্য কাউন্টারে ছুটে যাচ্ছেন তিনি। টিকেট না পাওয়ার বিষয়ে সুপ্রভাতকে কামরুল হাসান বলেন, ‘ব্যবসায়িক কাজে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে আসা। যেভাবেই হোক আমাকে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে। এখন পর্যন্ত দুই তিনটা কাউন্টারে ঘুরেই বাসের টিকেট পায়নি। টিকেট না পেয়ে ঢাকায় পৌঁছা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
দুপুর ৩টার দিকে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে দেখা যায় ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলাগামী যাত্রীদের ভিড়। ট্রেনের টিকেট বিক্রি বন্ধ থাকা বেশিরভাগ যাত্রী টিকেট কেনার জন্য কাউন্টারে তদবির করেই যাচ্ছে। টিকেট না থাকাতে বেশিরভাগ যাত্রীদের খালি হাতে ফিরে আসতে হয়েছে। এছাড়া প্রবেশ পথে টিকেট ছাড়া যাত্রীদের ঢুকতে না দেওয়ায় অনেকে বাধ্য হয়ে বাসের টিকেটের জন্য ফিরে যাচ্ছে। বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহগামী ট্রেন ঘুরে দেখা যায়, প্রতি দুই আসনে একজন করে বসার কথা বলা হলেও বাস্তবে সে চিত্র ভিন্ন। প্রতি সিটে যাত্রী বসার পাশাপাশি যাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এসময় বেশিরভাগ যাত্রীদের মুখে মাস্ক না থাকার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলার প্রবণতাও দেখা গেছে।
চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা যাওয়ার উদ্দেশে রেলওয়ে স্টেশনে এসেছিলেন ব্যবসায়ী জয়নুল আবেদীন। কিন্তু ট্রেনের টিকেট বিক্রি বন্ধ থাকায় কুমিল্লা পৌঁছা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তিনি। এসময় টিকেট না পাওয়ার বিষয়ে সুপ্রভাতকে তিনি বলেন, অনলাইনে ট্রেনের সব টিকেট বিক্রি হওয়াতে এখন টিকেট পাচ্ছি না। ট্রেনে যেতে না পারলেও বাস কিংবা ট্রাক যেভাবে হোক কুমিল্লায় পৌঁছাতে হবে। এখন কিভাবে কুমিল্লায় যাবো এইটা নিয়ে টেনশনে আছি।
বিকাল ৪টার দিকে শাহ আমানত সেতু এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, নগরী থেকে কক্সবাজার ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের উপজেলাগামী যাত্রীদের প্রচুর ভিড়। যাত্রীদের তুলনায় বাস কম থাকায় যাত্রীদেরকে অতিরিক্ত ৬০ শতাংশের চেয়ে বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে। এছাড়া বেশিরভাগ বাসে ৬০ শতাংশ অতিরিক্ত ভাড়ার পাশাপাশি প্রতিটি সিটে যাত্রী নিতে দেখা গেছে। এসময় যাত্রীরা ৬০ শতাংশের অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেন।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা ও অতিরিক্ত ভাড়া নিয়ে হয়রানির বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. উমর ফারুক বলেন, ‘লকডাউনের কারণে অন্যান্য সময়ের চেয়ে ঘরমুখো মানুষের ভিড় ছিল বেশি। সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আসন সংখ্যার অর্ধেক যাত্রী পরিবহনের সুযোগ থাকায় অনেক ক্ষেত্রে বাসের সংকট ছিল।
যাত্রীরা যাতে ভোগান্তির স্বীকার না হয়, সেজন্য জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে।