শত কোটি টাকার রপ্তানি বাণিজ্যে বাঁশখালীর শুঁটকি

বাঁশখালীর সরল ইউনিয়নের জালিয়াখালী গ্রামে জ্বলকদর খালের পাড়ে শুঁটকি শুকানোর দৃশ্য

উজ্জ্বল বিশ্বাস, বাঁশখালী  »

বাঁশখালী উপকূলে উৎপাদিত শুঁটকি শত কোটি টাকার রপ্তানি বাণিজ্যে যুক্ত। পাশাপাশি এখানে উৎপাদিত শুঁটকি দেশের মানুষের ৬৫% আমিষের চাহিদা পূরণ করছে। শুঁটকি শিল্পে অর্থনৈতিক নির্ভরতা বাড়াতে এবং নিরাপদ খাদ্য হিসেবে প্রস্তুত করতে মৎস্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সুনজর দেয়া দরকার বলে অনেকে মনে করেন। বাঁশখালী উপকূলে সামুদ্রিক পানিতে লবণের ঘনত্ব বেশি হওয়ায় এখানকার পানি দিয়ে লবণ উৎপাদন হয় বেশি। পানিতে লবণের ঘনত্ব বেশি থাকায় পরিবেশগত কারণে এখানকার উৎপাদিত শুঁটকি খেতে স্বাদে অতুলীয় এবং সংরক্ষণেও নির্ভরতা বেশি।

মৎস্যজীবীরা সনাতন পদ্ধতিতে পূর্ব পুরুষের অভিজ্ঞতা নিয়ে সাগর থেকে আহরিত সামুদ্রিক মাছ নানা ঝুঁকি সচেতনবিহীনভাবে উপকূলে যততত্র অরক্ষিত পরিবেশে শুকিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করছেন। অরক্ষিত স্থানে শুকনো শুঁটকিতে নানা প্রজাতির পশুপাখি জীবজন্তুর কামড়ে মুখের লালাযুক্ত জীবাণু ছড়ানোর আশঙ্কা থেকে যায়। ফলে উৎপাদিক শুঁটকিতে মানুষের জীবনের ঝুঁকিও বাড়ছে ভয়ংকরভাবে। উৎপাদিত শুঁটকি মহালে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের কোনদিন পা পড়েনি বলে শত শত মৎস্যজীবীরা অভিযোগ করেন।

মৎস্যজীবীরা বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আমাদের শুঁটকি পল্লীতে তদারকি করে স্বাস্থ্য রক্ষা নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে বুদ্ধিপরামর্শ দিলে শুঁটকি বিদেশে রপ্তানি করে আরও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা যেমন অর্জন হবে তেমনি স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তাও বাড়বে।
সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, বাঁশখালী উপকূলের ছনুয়া, গন্ডামারা, পুঁইছড়ি, শেখেরখীল, সরল, বাহারছড়া, কাথরিয়া, খানখানাবাদ চাম্বল ইউনিয়নের অন্ততঃ ৪২টি স্পটে শুঁটকি শুকানো হয়। উপকূলের বিশাল বিশাল এলাকা জুড়ে বাঁশের কঞ্চি বেঁধে মাঁচা তৈরি করে এবং রশি টাঙিয়ে ছাউনি ঘেড়ে শুঁটকি শুকানো হচ্ছে। প্রতিবছর ডিসেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বাঁশখালী উপকূলে নানাভাবে শুঁটকি শুকানো হয় বলে জেলেরা জানান।

দেখা গেছে, শুঁটকি শুকাতে শুঁটকির ওপরের অংশ অরক্ষিত থাকায় নানা প্রজাতির পশুপাখি জীবজন্তুর কামড় দিয়ে আধা শুকনো মাছ নিয়ে যাচ্ছে এবং রাতে স্পটগুলোতে মাছ ডেকে রাখলেও ওইসময় কুকুর, বিড়াল, শৃগালসহ নানা অজ্ঞাত প্রাণী খপ্পরে পড়ে। ওইসব প্রাণীর মুখের নানাধরনের লালায় শুঁটকি আক্রান্ত হলেও স্বাস্থ্যগতভাবে কোন সুপরামর্শ বা নির্দেশনা পান না জেলেরা। এছাড়া জেলেরা সনাতন পদ্ধতিতে কিছু কিছু জায়গায় পোকামাকড় থেকে রক্ষা করতে প্রত্যেকটি শুকনো মাছের মাথা বিষযুক্ত পানিতে ডুবানোর দৃশ্যও দেখা গেছে। শুকনো শুঁটকির মধ্যে রয়েছে লইট্টা, ছুরি, রূপচাঁন্দা, ফাইস্যা, মাইট্যা, কোরাল, লাখওয়া, পোঁহা, চিংড়ি শুঁটকিসহ আরও নানা প্রজাতির।

প্রতি কেজি মাছ কমপক্ষে ৮০০ থেকে সর্বোচ্চ ১২ হাজার টাকা পর্যন্ত পাইকারি ধরে বিক্রয় হয়। প্রতিবছর বাঁশখালী থেকে ১৫০ টন/ ২০০ টন পর্যন্ত শুঁটকি দেশেবিদেশে চালান হয়। যার বাজার মূল্য দেড়শত কোটি টাকার ওপরে। এসব শুঁটকি দেশের বিভিন্নপ্রান্তে চালানের পরও দুবাই, কাতার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভারত ইউরোপের ইত্যাদি দেশে রপ্তানি করা হয়। প্রতি মৌসুমে শুঁটকি উৎপাদনে বাঁশখালী উপকূলে প্রায় হাজার শ্রমিক কাজ করে থাকেন।
ছনুয়ার শুঁটকি উৎপাদনকারী ফজলুল কাদের বলেন, বাপদাদার পেশা ছিল জেলে পেশা। বাপদাদার কাছ থেকে শেখা সনাতন পদ্ধতিতে শুঁটকি শুকানোর কাজে আমরা ব্যস্ত থাকি। এই পেশা লাভজনক। তাই ছাড়তে পারি না। এছাড়া বাংলাদেশের অনেকে বিদেশে অবস্থানের কারণে দেশে উৎপাদিত শুঁটকির কদর বিদেশে বেশি, তাদের চাহিদা অনুসারেও বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিদেশে রপ্তানি করা হয়। জানা যায়, শত কোটি টাকার অধিক শুঁটকি বাঁশখালীতে উৎপাদিত হয়। যার উল্লেখযোগ্য ভাগ বিদেশে রপ্তানি হয়।

সরলের কাহারঘোনা গ্রামের শুঁটকি ব্যবসায়ী শামশুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘ ২২ বছর ধরে আমি শুঁটকির শুকানোর কাজ করে আসছি। আমার এখানে ৩৭ জন শ্রমিক মাসিক দৈনিক মজুরিতে কাজ করে। এদের মাসিক মজুরি ১২ হাজার টাকা থেকে ২৫ হাজার টাকা করে। দৈনিক মজুরিতে যারা কাজ করেন তাদের মধ্যে পুরুষের দৈনিক বেতন ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা, নারীর দৈনিক বেতন ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। পর্যন্ত মাসে শ্রমিকের মজুরি বাবদ লাখ টাকা থেকে ১১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। সময়ে বিভিন্ন চালানে কোটি টাকারও বেশি মাছ বিক্রি করেছি। সব খরচ বাদ দিয়ে এতে আমার ২৫ লাখ লাভ হয়েছে।

বাঁশখালীর সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. তৌসিব উদ্দিন বলেন, জেলেদের সামুদ্রিক মাছ আহরণের জন্য নানামুখি পরামর্শ দেয়া হয়। আলাদাভাবে শুঁটকি উৎপাদনের ওপর কোন প্রশিক্ষণ কিংবা আর্থিক সহযোগিতা করা হয় না। তবে স্বাস্থ্যসম্মত খাবার হিসেবে শুঁটকিকে দেশের অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে বাস্তবায়নে মৎস্য অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
বাঁশখালী উপজেলা স্যানিটরি ইন্সপেক্টর ছৈয়দ আকবরও বলেন, ‘নিরাপদ খাদ্য হিসেবে শুঁটকি উৎপাদন ক্ষেত্রগুলোও আমাদের তদারকি করা উচিত।