সুপ্রভাত ডেস্ক »
নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে অনেকেই মূল্যবান দলিল, কাগজপত্র ও স্বর্ণালঙ্কারসহ বিভিন্ন দামি জিনিস রাখার জন্য ব্যাংকের লকার ভাড়া নেন। নির্ধারিত ফি দিয়ে ফরম পূরণ করে নির্দিষ্ট লকারে সম্পদ রেখে দেন বছরের পর বছর। প্রতিবছর এই লকারে চার্জ আরোপ করে ব্যাংক। এর সঙ্গে ১৫ শতাংশ ভ্যাটও দিতে হয় গ্রাহককে।
প্রায় সব ব্যাংকে লকার নিতে শুরুতে অ্যাকাউন্ট খুলতে সার্ভিস চার্জ দুই হাজার টাকা দিতে হয়। এর বাইরে ছোট লকারের জন্য বছরে ৩ থেকে ৫ হাজার, মাঝারি ৫ থেকে ৮ হাজার এবং বড় লকারের জন্য ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয়। এছাড়া বেশিরভাগ ব্যাংকেই সিকিউরিটি হিসেবে জমা দিতে হয় আরও পাঁচ হাজার টাকা যা পরে ফেরতযোগ্য। লকারের চাবি হারিয়ে বা কোনও সময় পরিবর্তন করতে চাইলে চার্জ দিতে হয় অন্তত ছয় হাজার টাকা।
ব্যাংকিং কার্যক্রমের পাশাপাশি এভাবে লকার ভাড়া দিয়ে ব্যাংক প্রচুর টাকা আয় করছে, কিন্তু লকারে রাখা সম্পদ খোয়া গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে গ্রাহকদের জন্য ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনও আইনি সুরক্ষা নেই। এমনকি লকারে রাখা সম্পদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনেও কিছু বলা নেই। উল্টো ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে— লকার খুলতে ও লকারের ভেতরকার মালামাল ফেরত নিতে অনুমতি প্রদানের কারণে যদি দেরি হয় এবং মালামাল ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাহলে ব্যাংকের বিরুদ্ধে কোনও মামলা, অভিযোগ বা আইনানুগ কার্যধারা দায়ের বা শুরু করা যাবে না।
শুধু তাই নয়, লকারে রাখা মালামাল খোয়া গেলে বা গায়েব হলে ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
যদিও লকার ভাড়া নিতে গেলে ব্যাংক সব দায়দায়িত্ব নেবে বলে গ্রাহকদের আকৃষ্ট করা হয়। এমনকি মৌখিকভাবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় যে লকারে জমাকৃত জিনিস হারানো গেলে বা নষ্ট হলে ব্যাংক সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেবে। খবর বাংলা ট্রিবিউনের।
সাধারণত, লকার ভাড়া নেন বিত্তশালী ও সম্পদশালীরা। সম্প্রতি চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখার লকার থেকে গ্রাহকের এক কোটি ৭৪ লাখ টাকা মূল্যের ১৫০ ভরি স্বর্ণালংকার গায়েব হওয়াকে কেন্দ্র করে সারা দেশে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
এরআগে গত বছর জনতা ব্যাংকের যশোর করপোরেট শাখায় গ্রাহকের চাবি ছাড়াই লকার খোলার ঘটনায় লকারের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠে।
এর কয়েক বছর আগে রাজধানীর ব্র্যাক ব্যাংকের ধানমন্ডি শাখায় ব্যাংকের ওপর তলার ছাদ কেটে লকার কক্ষে ঢুকে ৭৫টি লকার ভেঙে ৬০টির মালামাল লুটে নেয় ডাকাতরা।
ইসলামী ব্যাংকের চকবাজার শাখার ম্যানেজার এসএম শফিকুল মাওলা চৌধুরী জানিয়েছেন, ক্ষতিগ্রস্ত মাঝারি লকারের গ্রাহক ক্ষতিপূরণ হিসেবে পাবেন মাত্র ২ লাখ টাকা। ইসলামী ব্যাংকের লকারের মালামাল গায়েব হওয়াকে কেন্দ্র করে লকার ভাড়া নেওয়া অন্যান্য ব্যাংকের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
অবশ্য অন্যান্য ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্যাংকের লকারে রাখা শত কোটি টাকার সম্পদ বা স্বর্ণালংকার খোয়া গেলেও লকার ব্যবহারকারী গ্রাহক ক্ষতিপূরণ পাবেন মাত্র ৩ লাখ টাকা। মাঝারি লকারের ক্ষতিপূরণ সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা আর ছোট লকার থেকে সম্পদ খোয়া গেলে ক্ষতিপূরণ পাবেন ১ লাখ টাকা। আর লকারে মালামাল রাখার পর টানা ১০ বছর বা ১০ বছরের বেশি সময় যদি কোনও গ্রাহক খোঁজখবর না রাখেন, বা তার কোনও হদিস না পাওয়া যায়, তাহলে তার মালামাল সামগ্রী লকার থেকে বের করে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা দিতে হয়।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১-এ এ বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। তিনি উল্লেখ করেন, আমি মনে করি ব্যাংকগুলো এ বিষয়ে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
ব্যাংকের সঙ্গে এই ধরনের অ্যাগ্রিমেন্ট (চুক্তি) করেই গ্রাহকরা ব্যাংকের লকার ভাড়া নিয়ে থাকেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, লকারে রাখা সম্পদের ক্ষতিপূরণের বিষয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনে কোথাও কিছু পরিষ্কার করে বলা নেই। লকারের মালামাল খোয়া গেলে বা গায়েব হলে গ্রাহককে ক্ষতিপূরণ কত টাকা সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। কারণ লকারের ভেতরে কি রাখা আছে তা গ্রাহক ছাড়া কেউ জানে না। এমনকি সংশ্লিষ্ট ব্যাংকও জানে না। তবে ভল্টের বা লকারের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা আছে। তিনি বলেন, লকারের ভেতরে থাকা সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক কত টাকা পাবে তা ব্যাংক নিজেরা নির্ধারণ করে। ব্যাংকগুলো নিজেরা গ্রাহকদের সঙ্গে চুক্তি করে লকার ভাড়া দিয়ে থাকে।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, ‘ব্যাংকের স্বর্ণালংকার রাখলে সেটি চুরি বা ডাকাতি হলে সাধারণত ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দায় নিতে চায় না। তবে স্বর্ণালংকারের ইন্স্যুরেন্স করা থাকলে সেই অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পেতে পারে।’
সাধারণত গ্রাহক থেকে লকারের সার্ভিস ফি আদায় করার সঙ্গে সঙ্গে ইন্স্যুরেন্স কাভারেজের টাকাও আদায় করা হয়। প্রকৃতপক্ষে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হলে এখান থেকেই ক্ষতিপূরণের টাকা দেওয়া হয়।
এদিকে লকার সম্পর্কিত ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যে পরিসরে সেফ ডিপোজিট ভল্টগুলোকে রাখা হয়েছে তার সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য ব্যাংক সমস্ত পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে, দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে ব্যাংকের নিজস্ব ত্রুটি, অবহেলা এবং কোনো ভুল বা কমিশনের কারণে ব্যাংকের পরিসরে আগুন লাগা, চুরি বা সিঁধ কেটে চুরি বা লুট করা, ডাকাতি, বিল্ডিং ধসে পড়ার মতো ঘটনার কারণে বা ব্যাংকের কর্মচারীদের দ্বারা করা প্রতারণার জন্য লকারের সামগ্রী নষ্ট হয়ে যায়, তবে ব্যাংকের দায়বদ্ধতা সেফ ডিপোজিট লকারের প্রচলিত বার্ষিক ভাড়ার একশ গুণের সমতুল্য টাকার পরিমাণে সীমাবদ্ধ থাকবে।
অবশ্য ২০১২ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি নির্দেশনা বলা হয়েছে, ১০ বছরের ও তার চেয়ে বেশি সময় লেনদেনবিহীন ও অদাবিকৃত লকারের ভেতরকার মালামাল সামগ্রী বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করতে হবে।
এদিকে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, গত কয়েক বছর ধরে গ্রাহকদের প্রয়োজনমতো লকার সরবরাহ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো। গুলশান, বনানী, ধানমন্ডি, উত্তরা, বসুন্ধরা, মতিঝিলসহ রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় ব্যাংকের শাখাগুলোয় এখন বড় লকারের চাহিদা বাড়ছে। একই পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে দেশের বিভাগীয় ও গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোয়ও। পরিস্থিতি সামাল দিতে লকার সেবার পরিধি বাড়াচ্ছে ব্যাংকগুলো। এর সঙ্গে সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে সেবাটির চার্জ বা ফিও।
ইসলামী ব্যাংক ছাড়াও রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের ৫৪টি শাখায় লকার সেবা রয়েছে। ব্যাংকটির ছোট লকারের বার্ষিক চার্জ ২ হাজার টাকা। মাঝারি ও বড় লকারের চার্জ যথাক্রমে ২ হাজার ৫০০ ও ৩ হাজার টাকা। রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকগুলোও প্রায় একই চার্জে গ্রাহকদের লকার সেবা দিচ্ছে। তবে বেসরকারি ও বিদেশি খাতের ব্যাংকগুলোর লকার চার্জ অনেক বেশি। যেমন- ছোট লকারের জন্য ৫ হাজার, মাঝারির জন্য ১০ হাজার ও বড় লকারের জন্য ১২ হাজার টাকা বার্ষিক চার্জ নিচ্ছে আইএফআইসি ব্যাংক।
গ্রাহকদের লকার সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে বেসরকারি খাতের দ্য সিটি ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির ৩৬টি শাখায় পাওয়া যাচ্ছে লকার সেবা। সিটি ব্যাংকের শাখা ও প্রধান কার্যালয়ে মোট লকার রয়েছে প্রায় চার হাজার। এর মধ্যে ১ হাজার ৭২৪টি লকার ছোট। ছোট লকারের জন্য ৫ হাজার, মাঝারির জন্য ৭ হাজার এবং বড় লকারের জন্য ৯ হাজার টাকা চার্জ আদায় করছে সিটি ব্যাংক।
অধিকাংশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের দাবি, সাধারণত লকারের রুম সিসিটিভির আওতায় থাকলেও ভাড়া নেওয়া লকারে রাখা পণ্যের যাবতীয় দায়দায়িত্ব গ্রাহকের। সেখানে গ্রাহকরা কী রাখছেন, ব্যাংকের পক্ষে সেটি দেখা বা যাচাইয়ের কোনও সুযোগ নেই। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি লকারের চাবির দুটি অংশ থাকে। একটি অংশ থাকে গ্রাহকের কাছে, বাকি অংশ থাকে ব্যাংকে। লকার খুলতে হলে চাবির দুটি অংশেরই প্রয়োজন হয়। গ্রাহক ব্যাংকে গেলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা চাবির দুটি অংশের সমন্বয়ে লকারের তালা খুলে দেন। গ্রাহক লকার ব্যবহারের সময় সেখানে কারও উপস্থিত থাকার সুযোগ থাকে না। অভিযোগ উঠেছে, লকারে কী আছে সেটি দেখার সুযোগ না থাকায় অনেক গ্রাহক সেবাটির অপব্যবহার করছেন। লকারে নগদ ডলারসহ বিদেশি মুদ্রা বেশি রাখা হচ্ছে। দেশে ডলার সংকট তীব্র হয়ে ওঠার পেছনে লকারে বিদেশি মুদ্রা রাখার প্রবণতাও এক প্রকার ভূমিকা রাখছে।