বাড়ছে অপরাধপ্রবণতা
রফিক উদ্দিন বাবুল, উখিয়া :
উখিয়া–টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে অপরাধপ্রবণতা দিন দিন জ্যামিতিকহারে বেড়ে চলেছে। বিশাল এলাকাজুড়ে অসংখ্য ঝুপড়ি থাকার সুবাদে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা অপরাধ প্রতিরোধে অভিযান চালিয়েও অপরাধীচক্রকে শায়েস্তা করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ সুযোগে ইয়াবার চালান ও পাচারের নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট এসব অপরাধের সাথে সরাসরি জড়িত। গত সোমবার কক্সবাজার র্যাব–১৫ সাগরে অভিযান চালিয়ে ১৩ লক্ষ ইয়াবাসহ দুজন রোহিঙ্গা নাগরিককে হাতেনাতে আটক করার ঘটনায় প্রমাণিত হয়, রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে মিয়ানমারের তৈরি ইয়াবা এদেশের বিভিন্ন স্থানে অভিনব কায়দায় পাচার হচ্ছে। আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা গত তিন বছরে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন অপরাধ কর্মকা– শনাক্ত ও গ্রেফতার পূর্বক প্রায় ৩ শতাধিক মামলা করেছে বলে জানা গেছে। এসব মামলার মধ্যে রয়েছে খুন, ডাকাতি, মাদক ও মানবপাচার, ধর্ষণ, অপহরণ, অস্ত্র ও সহিংসতা।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশনস) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সরোয়ার গণমাধ্যমকে জানান, গত ২৩ আগস্ট বিকাল ৫টার দিকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কক্সবাজর মাঝিরঘাট এলাকায় অভিযান চালিয়ে একটি মাছধরার বোটসহ ১৩ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। এ সময় আটক করা হয় মো. বিল্লাহ (৪৫) ও মো. আয়াছ (৩৮) সহ দুজন রোহিঙ্গা নাগরিককে। অপারেশনস অফিসার এটিকে ইয়াবাপাচারের সবচেয়ে বড় চালান বলে আখ্যায়িত করেন। কক্সবাজার র্যাব–১৫ এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মাদক ও মানবপাচারসহ বিভিন্ন অপরাধ বেড়েছে। ফলে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি থেকে ২০ জুন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় অভিযান পরিচালনা করে ১০ লাখ ৫৫ হাজার ৪০৯ পিস ইয়াবা ও ১৮৩ জনকে আটক করা হয়। তার মধ্যে শুধু ক্যাম্প থেকেই ৫ লাখ ৪১ হাজার ৭৪২ পিস ইয়াবাসহ ৬৫ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কয়েকজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হওয়ার কারণে অপরাধীরা সেখানে নিরাপদে অবস্থান করতে সক্ষম হয় এবং কিছু কিছু ক্যাম্প পাহাড় ও জঙ্গল সংলগ্ন হওয়ার সুবাদে খুনি, ডাকাত ও অপহরণকারী রোহিঙ্গারা দিনের বেলায় জঙ্গলে আশ্রয় নিলেও রাতে ক্যাম্পে চলে আসে। চালায় বিভিন্ন অপরাধকর্ম ও সহিংসতা। পাশাপাশি ইয়াবা লেনদেন ও মজুদ করে থাকে একটি শক্তিশালী রোহিঙ্গা ইয়াবা পাচারকারী সিন্ডিকেট। উখিয়া–টেকনাফের ৩৪টি ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ও ইয়াবাপাচার প্রতিরোধে চলতি বছরের জুলাই থেকে দায়িত্ব পালন করছে পুলিশের বিপরীতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সদস্যরা। এর আগে সেখানে জেলা পুলিশ দায়িত্বে ছিল বলে জানা গেছে সংশ্লিষ্ট সূত্রে। গত জুলাই মাসে ক্যাম্পে দায়িত্বরত ১৬ এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা মাদক ও অস্ত্রসহ ১৬ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে। তাদের কাছ থেকে সাড়ে ৩ হাজার পিস ইয়াবা, ৩টি অস্ত্র ও ৩০ লিটার চোলাই মদ উদ্ধার করা হয়।
এ ব্যাপারে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন অধিনায়ক (পুলিশ সুপার) হেমায়েতুল ইসলাম বলেন, ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কাজ করছি গত একমাস ধরে। প্রতিনিয়ত এসব ক্যাম্প থেকে অপরাধমূলক কর্মকা–ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। তবে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে, তা নয়। বিভিন্ন সহিংস কর্মকা–ের সাথে জড়িত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার ও মামলা দায়ের করা হচ্ছে। সন্ত্রাসী রোহিঙ্গাদের দমনে এপিবিএন পুলিশ সদস্যরা ঝুঁকিপূর্ণ ক্যাম্প এলাকাগুলোতে সার্বক্ষণিক তৎপর রয়েছে ।
স্থানীয়দের তথ্যমতে, ক্যাম্পসংলগ্ন পাহাড়ঘিরে সংঘবদ্ধ ডাকাতবাহিনী সক্রিয় রয়েছে। জকির ও হাকিম ডাকাতের নেতৃত্বে অস্ত্রধারী সংঘবদ্ধ ডাকাতদল টেকনাফের নাইট্যংপাড়া, হোয়াইক্যং, মিনা বাজার, শালবন, মনখালী, চোয়াংখালী, ছেপটখালী, মাদারবনিয়ার গভীর জঙ্গলে আস্তানা গেড়ে ধারাবাহিক ডাকাতি করে যাচ্ছে। এছাড়া বিত্তশালী রোহিঙ্গাদের ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করছে। এমনকি তারা মিয়ানমার থেকে চোরাইপথে আসা ইয়াবার বড় বড় চালানও সংরক্ষণ করে থাকে। এসব ইয়াবা সাগরপথে মাছধরা ট্রলারে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত টেকনাফ বিজিবি বিভিন্ন সময়ে পৃথক অভিযান চালিয়ে ৩২ লাখ ৮৬ হাজার ইয়াবাসহ ১৩২ জন রোহিঙ্গাকে আটক করে থানায় সোপর্দ করেছে।
টেকনাফ ২ বিজিবি’র অধিনায়ক লে. কর্নেল মোহাম্মদ ফয়সল হাসান খান সাংবাদিকদের জানান, সীমান্তে বিজিবি সদস্যদের অতিরিক্ত সর্তকতা অবলম্বনের কারণে ইয়াবাপাচারের ধারাবাহিকতা একটু হ্রাস পেয়েছে। তবে রোহিঙ্গাদের কারণে ইয়াবাপাচার সম্পূর্ণ বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ রোহিঙ্গারা ইয়াবা কিভাবে সংগ্রহ করতে হয়, কীভাবে মিয়ানমারে যেতে হয় এবং সেখান থেকে ইয়াবার চালান এনে কীভাবে সংরক্ষণ করতে হয় সে ব্যাপারে বেশ অভিজ্ঞ। যে কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ইয়াবার প্রচলন একটু বেশি। তবে সরকারের মাদকের বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেন্স নীতি অবলম্বন করে বিজিবিও শক্ত অবস্থানে রয়েছে।