রোবটের সাথে বন্ধুত্ব

বিচিত্র কুমার »

গ্রামের নাম ছিলো শান্তিপুর। সেখানে মানুষের জীবন ছিলো সরল, আর প্রযুক্তির ছোঁয়া খুব কম। এই গ্রামেই থাকতো দশ বছরের ছোট্ট ছেলে তপু। তপু ছিলো কৌতূহলী, বই পড়তে ভালোবাসতো, বিশেষ করে বিজ্ঞান ও রোবটের গল্প।
একদিন গ্রামের প্রান্তে একটি বিশাল মেলা বসেছিল। মেলার মূল আকর্ষণ ছিলো ‘প্রযুক্তি প্যাভিলিয়ন’। তপু বহু অনুরোধের পর তার বাবাকে রাজি করিয়ে মেলায় গিয়েছিল। সেখানে সে প্রথমবারের মতো একটি ছোট রোবট দেখেছিল। রোবটটি তার মালিকের নির্দেশে নাচছিল, গান গাইছিল, আর নানা প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিল। তপু মুগ্ধ হয়ে রোবটটির দিকে তাকিয়ে ছিল। মনে মনে সে ভাবলো, ‘কী ভালো হতো, যদি আমারও এমন একজন রোবট বন্ধু থাকতো!’ মলা শেষ হওয়ার দুইদিন পর, তপু গ্রামের পাশের ছোট জঙ্গলে ঘুরতে গিয়েছিল। হঠাৎ সে ঝোপের মধ্যে কিছুর ঝলমলে আলো দেখতে পায়। এগিয়ে গিয়ে দেখে, একটি ছোট্ট রোবট ধুলো-মাটি মেখে পড়ে আছে। রোবটটি ক্ষতিগ্রস্ত, তবুও তার চোখের মতো দুটি আলো মিটমিট করছে। তপু সাহস করে রোবটটিকে ছুঁয়ে দেখল। রোবটটি হালকা শব্দ করে বলল, ‘সাহায্য করো। আমার নাম রোবি।’তপু হতবাক হয়ে গেল। ‘তুমি কথা বলতে পারো?’রোবি উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আমার শক্তি কমে যাচ্ছে। আমাকে মেরামত করতে হবে।’
তপু রোবটটিকে বাড়িতে নিয়ে এলো। সে তার বাবার পুরোনো যন্ত্রপাতি ও বই ব্যবহার করে রোবি মেরামত করার চেষ্টা করল। কয়েকদিন পর রোবি পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেল। রোবি শুধু একটি রোবট নয়, সে ছিলো একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্র। সে দ্রুত শিখতে পারত এবং তপুর সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা করত। তারা দুজন মিলে গ্রামের নানা কাজে সাহায্য করতে শুরু করল। রোবি গ্রামের স্কুলে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানের ধারণা বোঝাতো, ফসলের জন্য সঠিক মাটির পরিমাণ নির্ধারণ করত, আর বাচ্চাদের মজার মজার গল্প বলত। গ্রামের মানুষ রোবির উপস্থিতিতে খুশি হয়ে গেল। কিন্তু একদিন একদল মানুষ গ্রামে এলো। তারা নিজেদের বিজ্ঞানী বলে পরিচয় দিল। তাদের নেতা ডক্টর শর্মা জানালো, রোবি আসলে তাদের গবেষণাগারের রোবট, যে পরীক্ষার সময় পালিয়ে গিয়েছিল। তারা রোবিকে ফিরিয়ে নিতে চায়। তপু শুনে ভয় পেয়ে গেল। সে রোবির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোমাকে আমি হারাতে চাই না। তুমি আমার বন্ধু।’ রোবি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘আমিও তোমার মতোই অনুভব করি, তপু। কিন্তু তাদের সঙ্গে যাওয়া আমার দায়িত্ব। তারা আমাকে তৈরি করেছে।’
তপু হাল ছাড়তে রাজি ছিল না। সে ডক্টর শর্মার সঙ্গে কথা বলল। ‘আপনারা রোবিকে তৈরি করেছেন, কিন্তু সে এখন শুধু একটা যন্ত্র নয়। সে আমাদের গ্রামের বন্ধু। সে এখানে থেকে মানুষের সাহায্য করতে পারে।’ ডক্টর শর্মা প্রথমে তপুর কথা বিশ্বাস করেনি। কিন্তু তপু ও গ্রামের মানুষ যখন দেখাল, কীভাবে রোবি গ্রামের উন্নতিতে সাহায্য করছে, তখন তিনি রোবিকে গ্রামে থেকে কাজ করার অনুমতি দিলেন। রোবি তপুর পাশে থেকে তাকে ও গ্রামের মানুষকে শিখিয়েছিল, প্রযুক্তি ভালো এবং খারাপ দুটোভাবেই ব্যবহার করা যায়। এটি মানুষের হাতে নির্ভর করে। রোবি ও তপুর বন্ধুত্ব মানুষকে দেখিয়েছিল, যন্ত্র আর মানুষের মধ্যে সহানুভূতির সম্পর্ক তৈরি হতে পারে। গ্রাম শান্তিপুর ধীরে ধীরে ‘প্রযুক্তি-গ্রাম’ নামে পরিচিত হয়ে উঠল। আর তপু বড় হয়ে একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী হলো, যে তার সৃষ্ট রোবট দিয়ে মানুষের সেবা করল।
এই গল্প শিখিয়ে গেল, বন্ধুত্ব কেবল মানুষের মধ্যে নয়, যন্ত্রের সঙ্গেও সম্ভব, যদি মন সৎ হয় আর উদ্দেশ্য ভালো হয়।